খুন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, পকেটমারি, খাদ্য ও ওষুধে ভেজাল মেশানো, বেআইনি মজুতদারি, কালোবাজারি, ঘুষ খাওয়া ইত্যাদি অবশ্যই অপরাধ। তা বলে পাগল, মানসিক রুগী ও জনবলের দিকে কমজোর মানুষকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাওয়া ও প্রয়োজন হলে তার ঘাড়ে অন্যায়ভাবে মিথ্যা দোষ চাপিয়ে দেওয়া কি অপরাধের নয়? বরঞ্চ অনেক বেশি জঘন্য এবং অতি চরম অপরাধ। মানুষ কবে এটা উপলব্ধি করবে ? কবে হবে এই ঘৃণ্য প্রবৃত্তির অবসান? এ নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশেষ বিশ্লেষণ করেছেন সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মানুষের সমাজে অনেক রকমের অপরাধ আছে যেমন, খুন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, পকেটমারি, খাদ্য ও ওষুধে ভেজাল মেশানো, বেআইনি মজুতদারি, কালোবাজারি, ঘুষ খাওয়া ইত্যাদি। কিন্তু চরম অপরাধ হয়েও একটি বিষয় মানুষের কাছে অপরাধের তালিকায় আসেনা অথচ গভীরভাবে বিচার করলে সেটি অতি জঘন্য ও চরম অপরাধ। হালকা মানসিক রোগে আক্রান্ত ১৮-১৯ বছরের যুবক ‘ নিহার ‘-কে ( নাম পাল্টানো ) চিকিৎসার জন্য তার বাবা একজন মানসিক চিকিৎসকের কাছে এনেছিলেন। চেম্বারের বাইরে রুগী ও বাড়ির লোকের বসার জায়গায় তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন। তখন রাত প্রায় ১০টা,সেখানে কেবল তাঁরাই ছিলেন। চেম্বারের ভিতরে তখনও আগের রুগী রয়েছে। স্থানীয় একটি ক্লাবের ৪০-৪৫ বছরের ৬-৭ জন যুবক ডাক্তারবাবুর কাছে একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের জন্য চাঁদা তুলতে এসে ওখানে বসল। নিহারকে দেখিয়ে ওদের একজন তার সঙ্গীদের বলল,” মালটা মনে হয়, আফ্রিকার জঙ্গল থেকে এসেছে, রে”। আরেকজন বলল, “ না না, চিড়িয়াখানার মাল”। ওরা সবাই ফিকফিক করে হাসতে লাগল। ওদের এই মন্তব্য ও হাসিতে নিহার ও তার বাবার মনে খুব আঘাত লাগল। নিহারের বাবা এর প্রতিবাদ করলেন। কিন্তু ওরা পাল্টা নিহারের নামে একটা মিথ্যা দোষ চাপিয়ে দিল। ওদের একজন বলল, “ আপনার ছেলেই তো প্রথমে আমাদের দিকে মুখভেঙচে উঠল”। দলের সবাই তাকে সমর্থন করল। কিন্তু বাস্তবে নিহার তো আদৌ মুখ ভেঙচে ওঠেনি। তাই নিহারের বাবা খুবই ক্ষুব্ধ হলেন। যথেষ্ট ঠাণ্ডাভাবেই ওদের বললেন, “আমি তো পাশেই রয়েছি, সে একদমই কাউকে ভেঙচে ওঠেনি ,তাছাড়া এইরকম কাজ সে কোনোদিন এবং কোথাও করে না”। যুবকেরা বলল,” আমরা দেখলাম ভ্যাঙচালো আর আপনি বলছেন সে ওটা করেনি,আজব কেস রে ভাই। আসলে কোনও বাবা-মা’ই তাঁদের ছেলে-মেয়েদের দোষ দেখতে চান না”। নিহারের বাবার সাথে ওদের আরও কথা কাটাকাটি হতে যাচ্ছিল কিন্তু ওরা কিছুটা রুক্ষভাবে নিহারের বাবাকে বলে উঠল, আপনি বুঝবেন না ,আপনার সাথে কথা বলে লাভ নেই , চুপচাপ বসে থাকুন আর যে কাজ করতে এসেছেন সেটা করে চলে যান”। বাংলার সমাজের সাথে সারা পৃথিবীর একটা মৌলিক পার্থক্য যে, এখানে স্থানীয় ক্লাবকে সবাই সমীহ করে চলে, মানুষ জানে যে, ক্লাবের সঙ্গে অশান্তি করে পারা যায় না। অথচ ক্লাবের সদস্যরা কেউ সমাজবিরোধী নয়। এই সমাজের মানুষ হয়ে, নিহারের বাবা তাই চুপ করে গেলেন।
নিজে বাঙালি হয়েও বলতে দ্বিধা নেই যে, বাংলার সমাজের একটি ঘৃণ্য বৈশিষ্ট্য হল যে, পাগল, মানসিক রুগী ও জনবলের দিকে কমজোর মানুষকে কষ্ট দিয়ে অন্যেরা আনন্দ পায়। এতে লাভ কিছুই হয় না, তবু মানুষ এটা করে তৃপ্তি পায়। এইভাবে আনন্দ পাওয়া চরম অপরাধের, তবু মানুষ এটা করে। বলা বাহুল্য যে, যারা এইভাবে আনন্দ উপভোগ করে, তারা সবাই সাধারণ তথা সামাজিক মানুষ, কেউ সমাজবিরোধী নয়। আবার, পাল্টা কোনও প্রতিবাদ এলে সেই অত্যাচারিতের ওপরই একটা কোনও মিথ্যা দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়। এখানে যেমন, নিহারের বিরুদ্ধে ভ্যাঙচানোর মিথ্যা বদনাম চাপিয়ে দেওয়া হল। খুন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, পকেটমারি, খাদ্য ও ওষুধে ভেজাল মেশানো, বেআইনি মজুতদারি, কালোবাজারি, ঘুষ খাওয়া ইত্যাদি অবশ্যই অপরাধ। তা’ বলে পাগল, মানসিক রুগী ও জনবলের দিকে কমজোর মানুষকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাওয়া ও প্রয়োজন হলে তার ঘাড়ে অন্যায়ভাবে মিথ্যা দোষ চাপিয়ে দেওয়া কি অপরাধের নয় ? বরঞ্চ অনেক বেশি জঘন্য এবং অতি চরম অপরাধ। আলোচনার জায়গায় মানবাধিকার নিয়ে আমরা অনেক কথা বলি। কিন্তু মানবাধিকারকে তো আমরা নিজেরাই বারে বারে পদাঘাত করি। মানুষ কবে এটা উপলব্ধি করবে ? কবে হবে এই ঘৃণ্য প্রবৃত্তির অবসান ?
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও সমাজবিদ)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct