মহানুভব পাগল
মুহাম্মদ সেলিম রেজা
_________________
ট্রেন স্টেশনে পৌঁছাতে অপেক্ষমান যাত্রীরা হুড়মুড় করে উঠতে শুরু করল। পক্ষান্তরে ট্রেনের ভিতরে যারা আছেন তাঁরা নামবেন। দু’-য়ে মিলে সে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। ধাক্কাধাক্কি, গুঁতোগুঁতি, খিস্তি-খেউর চলছে দেদার। এসবে আমার পোষায় না। কিন্তু এই ট্রেনে উঠতে না পারলে আজ আর বাড়ি ফেরা হবে না। কোনরকমে একজনের বগলের ফাঁকে মাথা গলিয়ে দিয়ে দরজার কাছাকাছি চলে এলাম। বাকি কাজ ভিড় করে দিল, এক ঠেলায় একেবারে কামরার মাঝখানে পৌঁছে গেলাম। ভিতরে ততটা ভিড় নেই। আমার আগে-পিছে যারা উঠেছিল তাদের অনেকে সিট পেয়ে গেল। আমিও যে চেষ্টা করিনি তা নয়, ঠিকঠাক কৌশল জানা না থাকায় তা আর সম্ভব হয়ে উঠল না। অগত্যা একটু ফাঁকা জায়গা বেছে নিয়ে থিতু হলাম। মনে আশা সাঁইথিয়া-মল্লারপুরে কেউ না কেউ নিশ্চয় নামবে, তার জায়গায় দখল নেব। আমি তখন কলেজ ছাত্র, থার্ড ইয়ার চলছে। সে বছর ভাই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে। তার ভর্তি ব্যাপারে লাভপুর কলেজে গিয়েছিলাম। কলেজে কাজ শেষ করে আহম্মদপুর স্টেশনে পৌঁছালাম তখন বিকেল দেড়টা-দু’টো। দানাপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ছাড়া আপে যাবার কোন গাড়ি নেই। অগত্যা স্টেশনে দীর্ঘ অপেক্ষা, নির্ধারিত সময়ে অনেক পরে ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্ম ছুঁতে তার অবসান ঘটল।
আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক তার সামনের সিটে তিনজন বসে আছেন। আর একজন অনায়াসে বসা যায়। সূযোগটা হাত ছাড়া করলাম না। মাঝ বয়সি এক ভদ্রলোক, মাথায় মস্তবড় টাক, ভাড়ি ফ্রেমের চশমার ভেতরে বুদ্ধিদীপ্ত একজোড়া চোখ, পড়নে পাজামা-পাঞ্জাবি, কোলের উপর একটা শান্তিনিকেতন মডেলের কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে বসে আছেন। অনুমান করলাম তিনি কবি-সাহিত্যিক হলেও হতে পারেন, নাহলে শিক্ষক । তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললাম, স্যার একটু সরে বসবেন! তিনি আমার মুখের দিকে তাকালেন। তারপর বামদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে, পজিশান দেখে নিয়ে একটু সরে গিয়ে ইঞ্চি চারেক মতো জায়গা ছেড়ে দিয়ে বললেন, বস। ধন্যবাদ জানিয়ে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে বসতে যাব এমন সময় পিছনদিক থেকে নারী কন্ঠ ভেসে এল, ভাই আমাকে বসতে দাও দয়া করে। পিছন ফিরে দেখি এক যুবতী, বয়সে আমার থেকে কিছুটা বড়ই হবে, কোলে শিশুসন্তান নিয়ে অনুমতির অপেক্ষা করছে।সরে গিয়ে তাকে বসার সূযোগ করে দিলাম। বসতে বসতে সে বলল, ক’দিন থেকে মেয়েটির জ্বর ছাড়ছে না, ডাক্তার দেখাতে এসেছিলাম। সেই ভদ্রলোক অসুস্থ মেয়েটির হাত চেপে ধরলেন। চোখের পাতা ফাঁক করে দেখলেন।বুকে হাত দিয়ে বার তিনেক আলতো চাপ দিলেন অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতো। তারপর বললেন, ঠাণ্ডা লাগিয়েছ। দেখি ডাক্তার কি কি ঔষধ দিয়েছেন? যুবতী ব্যাগ হাঁতড়ে প্রেসক্রিপশন বার করে ভদ্রলোকের হাতে দিলে তিনি খুঁটিয়ে দেখে দু’টো ঔষধের নাম করে বললেন, ওগুলো খাওয়াবার দরকার নেই। ওতে কোন কাজ হয় না।
- আমি তো সব ঔষধ কিনেছি। বলল যুবতী।
- কেন যে ডাক্তাররা এইসব ফালতু ঔষধ লেখে? শুধু শুধু পেসেন্ট পরিবারের অর্থ ধ্বংস করা। দিনে দিনে সবাই অর্থ পিশাচ হয়ে উঠছে। নূন্যতম মানবিকতা বোধ নেই কারও। ভদ্রলোকের কথা শুনে যুবতী বিমর্ষ হয়ে পড়ল। অসুস্থ বাচ্চাটাকে বুকে চেপে ধরে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, ধার-দেনা করে সাতশো টাকা এনেছিলাম। ডাক্তার ফি নিয়েছে দেড়শো টাকা, আর পাঁচশো টাকার ঔষধ। পঞ্চাশ টাকা আসা-যাওয়ার ভাড়া। সারাদিন না খেয়ে আছি। বাচ্চাটাকে বুকের দুধ ছাড়া কিছু খাওয়াতে পারিনি। একথা শুনে ভদ্রলোক ব্যাগ খুলে চার পিস প্রমাণ সাইজের মর্তমান কলা বার করে বললেন, এগুলো খেয়ে নাও।
- আমি!
- হ্যাঁ। খেয়ে নাও। মিস্টি হেসে বললেন ভদ্রলোক। যুবতী আর কথা না বাড়িয়ে কলাগুলো নিয়ে ছাল ছাড়িয়ে খেতে শুরু করল। সামনে সাঁইথিয়া জংশন। যারা নামবেন সিট ছেড়ে দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। এমনই একজনের ছেড়ে যাওয়া সিটের দখল নিয়ে বসে পড়লাম। ট্রেন স্টেশনে থামলে যতজন নামলেন তার দ্বিগুণ উঠলেন, সাথে নানারকম দ্রব্যসামগ্রীর পসরা নিয়ে অগনিত হকার।
- দাদা চা খাবেন, চা।
- সাঁইথিয়ার স্পেশাল চপমুড়ি মাত্র দেড় টাকা প্যাকেট। কার কার লাগবে বলুন। মাত্র তিন টাকায় গরম গরম ডিম টোস্ট। এ সূযোগ আর কোথাও পাবেন না। দেব নাকি দাদা?
- নেল কাটার, চিরুনি, রুমাল, বাচ্চাদের হরেক রকম খেলনা আছে আমার কাছে। কারও লাগলে বলবেন দাদা।
- দাদা দেব নাকি ছাল ছাড়িয়ে নুন ছিটিয়ে কচি কচি শশা। গরমে আরাম, পিপায় শান্তি রসে ভরা ক্ষীরা।
- এই যে দাদা, ইঁদুরের বাচ্চা, আরশোলার ছা, টিকটিকি, মশা, মাছি যদি আপনার ঘরে নাচানাচি করে তবে আমার কাছে আসুন। আসামের বিশেষ ঘাসের রস দিয়ে তৈরী এই ট্যাবলেটটা নিয়ে যান। ঘরের এক কোণে ঝুলিয়ে রাখুন, ইঁদুর লাফালাফি করবে না, মশা-মাছি-আরশোলা বাপ বাপ করে ঘর ছেড়ে পালাবে। এই যো এক দাদা হাত বাড়িয়েছেন। আর কার কার লাগবে বলুন? তাড়াতাড়ি হাত তুলুন, বেশি স্টক নেই। যিনি আগে হাত তুলবেন তিনি আগে পারেন। দাম মাত্র দু’টাকা। দু’টাকা, দু’টাকা, দু’টাকা। এক বাউলের কন্ঠস্বর আগে থেকে শোনা যাচ্ছিল। তিনি গাইতে গাইতে ক্রমশ এগিয়ে আসছেন। আর একজন তারস্বরে চিৎকার করে ভিক্ষে চাইছে। সমবেত চিৎকারে কান ঝালাফালা হবার জোগাড়। যুবতীর কন্যাসন্তান এতক্ষণ মায়ের কোলে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। চিৎকার- চেঁচামেচিতে তার ঘুম ভেঙে গেলে ট্যাঁ ট্যাঁ করে কেঁদে উঠল। যুবতী তাড়াতাড়ি বাচ্চাকে শাড়িতে ঢেকে নিয়ে দুধ পান করাতে লাগল। তখন ভদ্রলোক বললেন, সারাদিন নিজে কিছু খাওনি বুকে দুধ আসবে কো’থেকে? দাঁড়াও আমি দেখছি কি করা যায়। যুবতী কোন উত্তর না দিয়ে লজ্জায় মাথা নীচু করল। ভদ্রলোক এক ফল বিক্রেতাকে ডেকে দু’টো কমলালেবু কিনে যুবতীর হাতে দিয়ে বললেন, রস গেলে বাচ্চার মুখে দাও।
যুবতী ফল নিতে ইতস্তত করলে ভদ্রলোক একটা কমলালেবু ফাটিয়ে দু’টো কোয়া বার করে, প্রায় জোর করে যুবতীর হাতে গুঁজে দিলেন। অগত্য সে লেবুর রস গেলে মেয়েকে খাওয়াতে লাগল।ভদ্রলোকের গায়ে পড়া ভাব, জোর করে উপকার করার প্রবণতা আমার ভালো লাগছিল না। একটি অসহায় মেয়েকে বাগে পেয়ে কী তিনি অবৈধ ফায়দা লুটতে চাইছেন? এই জিজ্ঞাসা মাথার ঘুরঘুর করতে থাকে। ততক্ষণে ট্রেন গড়াতে শুরু করেছে। অধিকাংশ হকার নেমে গেল। কোলাহলও অনেকটা স্তিমিত এসেছে। এই অবসরে আমি ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কী চিকিৎসক?
- না। কেন বলতো?
- চিকিৎসক নন, অথচ একজন পাশ করা ডাক্তার সুপারিশের বিরুদ্ধে কথা বলছেন?
- তুমি বাচ্চা ছেলে সোনা, দুনিয়ার অনেক কিছু দেখা বাকি আছে তোমার। ওই ঔধষগুলো কোন কাজের না। টাকার বিনিময়ে ডাক্তাররা ওইসব লেখে।
- আপনি কী করে জানলেন ওই ঔষধে কাজ হয় না?
- আমার বাবা একজন প্রথিতযশা ডাক্তার ছিলেন। তিনি কখনও ওসব লিখতেন না। কিন্তু আজকাল ডাক্তার, শুধু ডাক্তার কেন? ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, উকিল-ব্যারিস্টার কারও সেবার মানসিকতা নেই। টাকার পিছনে দৌড়াচ্ছে সব।
- টাকা কামানো অপরাধ?
- পেশার সাথে বেইমানি করতে না হলে অপরাধ নেই। কিন্তু....
এক বৃদ্ধা একটি বাচ্চা ছেলের হাত ধরে ভিক্ষা চাইতে চাইতে এগিয়ে এসে ভদ্রলোকের সামনে হাত পেতে দাঁড়ালেন। তা দেখে ভীষণ রেগে গেলেন তিনি। ভিক্ষে তো দিলেনই না, উল্টে বৃদ্ধার উপর চোটপাট শুরু করলেন - এই বুড়ি বাচ্চাটাকে কেন সাথে নিয়েছ? লজ্জা করে না, দুধের বাচ্চাটার জীবন নষ্ট করছ। স্কুলে পাঠাতে না পার, কিছু একটা কাজ শেখাও ভবিষ্যতে করে খাবে।
- কী করব বাবা চোখে দেখতে পাই না।
- কানা তো পথে পথে ঘোরার কী দরকার। এক জায়গায় বসেও তো ভিক্ষে করতে পার? তারপর তিনি গলা উঁচু করে সকল যাত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন, শিশুকে দিয়ে ভিক্ষে করানো এক প্রকার ক্রাইম। যতক্ষণ শিশুটি তার সাথে আছে, তাকে কোন প্রকার সাহায্য করার অর্থ আপনিও অপরাধী। একটি পয়সাও কেউ দেবেন না বুড়িকে। পাশে উপবিষ্ট এক সহযাত্রী তখন বললেন, যাই বলুন মশাই ওদের পরিবর্তন হবে না।
- হবে না মানে? সবাই যদি এভাবে ওকে ফিরিয়ে দেয় তাহলে....।
- বড়জোর একটা সিকি বা আধুলি দেব, তার আবার বাছবিচার?
- করতে হবে মশাই। তা নাহলে ভিক্ষবৃত্তির পরম্পরা কখনই নিরসন হবে না। আর একজন সহযাত্রী বললেন। তাঁর কথা লুফে নিয়ে ভদ্রলোক দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে বললেন, বংশ পরম্পরায় কিছু মানুষ ভিক্ষাবৃত্তি আঁকড়ে পরে থাকবে, এটা বেশিদিন চলতে দেওয়া যায় না। তাদের বোঝাতে হবে, অন্যের কাছ থেকে চেয়ে মাংস-ভাত খাওয়ার চাইতে কষ্টার্জিত অর্থে শাক-ভাত খাওয়া উত্তম।
- বুঝলে তো বোঝাবেন মশাই? আমাদের গ্রামে চার-পাঁচটি পরিবার ভিক্ষাবৃত্তির সাথে জড়িত আছে। বছর চারেক আগে পুজো কমিটির তরফে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল পুজোর খরচ কমিয়ে ওই পরিবারগুলিকে আর্থিক সাহায্য করা হবে, শর্ত একটাই ওরা আর ভিক্ষা করবে না। কেউ রাজি হয়নি। বুক ফুলিয়ে তারা বলেছিল, এই বেশ আছি। বললেন দ্বিতীয় সহযাত্রী।
- ইসলামে যাকাত, ফেতরা, ইত্যাদি কয়েক প্রকার দানের কথা বলা হয়েছে। সেইসব দানের অর্থ একত্রিত করে যদি ঠিকভাবে যোগ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় তাহলে কাউকে অন্যের কাছে হাত পাততে হবে না। সমস্যা হল সঠিকভাবে তা আদায় হয় না, তেমনি চাহিদাসম্পন্ন মানুষের হাতে তা ঠিকঠাক পৌঁছায় না। বললেন প্রথম সহযাত্রী। ভদ্রলোক বুক পকেট থেকে ডায়েরী-কলম বার করে দুই সহযাত্রীকে অনুরোধ করলেন, আপনাদের নাম ঠিকানা বলুন লিখে নিই। পরে আমি আপনাদের সাথে যোগাযোগ করব। সবাই মিলে যদি এই দুঃস্থ মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে পারি। ভদ্রলোকের ডাকে তাঁরা সাড়া দিলেন না। প্রথম সহযাত্রী পরের স্টেশনে নামতে হবে বলে তড়িঘড়ি উঠে গেলেন। দ্বিতীয়জন দায় সারলেন এই বলে, অরণ্যে রোদন ব্যতীত কিছু হবে না মশাই। ওদের, ওদের মতো থাকতে দিন। ভদ্রলোক নিরাশ হয়ে ডায়েরী-কলম পকেটে রেখে দিয়ে স্বগোক্তি করলেন, দিন কানায় দুনিয়া ভরে গেছে। আমার কি সাধ্য সকলকে চক্ষুদান করি! যুবতী একরাশ বিস্ময় নিয়ে ভদ্রলোকের মুখপানে চেয়ে বসে আছে। সে কী ভাবছে জানি না। তার শিশুকন্যাটি মায়ের কোলে বসে আপন খেয়ালে হাত-পা নেড়ে চলেছে। এদিকে আমার অন্তরমহলে ভদ্রলোককে কেন্দ্র করে কৌতুহলের মাত্রা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।কিছুক্ষণ পূর্বেও তাঁর সম্পর্কে আমার মনে একটি নেতিবাচক ধারণার বীজ তিরতির করে বাড়তে শুরু করেছিল। এখন তা চিরতরে নির্বাপিত হয়ে গিয়ে নবদিবসের আগমনী বার্তা গাইতে শুরু করেছে। যেখানে ভাই ভাইয়ের কথা ভাবে না। ছেলে বাবাকে এড়িয়ে চলে। আর এই তিনি কিনা...
- হ্যাঁ গো মা তুমি একাই এসেছিলে ডাক্তারের কাছে? ভদ্রলোকের কথায় আমার চিন্তাসূত্র ছিহ্ন হল।
- হ্যাঁ।
- তোমার স্বামী আসেনি?
- ও তো বাইরে আছে। সুরাটে কাপড়ের কলে কাজ করে।
- ও! তোমার বাবা-মা, শ্বশুড়-শ্বাশুরি কাউকে আনতে পারতে সাথে।
- বলেছিলাম। আসতে পারেনি ওরা। ঝাড়খণ্ডের লক্ষ্মণপুর গ্রামে যুবতীর বাড়ি। পাকুড় থেকে মাইলখানেক দূরত্বে লক্ষ্মণপুর গ্রাম, মেঠো আলপথ ধরে আধঘন্টার রাস্তা। হিসেব মতো রাত আটটার আগে ট্রেন পাকুর পৌঁছাতে পারবে না। রাতের অন্ধকারে যুবতী
কীভাবে গ্রামের বাড়ি পৌঁছাবে ভেবে ভদ্রলোক বিচলিত হয়ে পড়লেন। চিন্তা আমারও হচ্ছিল, শোনা আছে ওই এলাকায় রাতের অন্ধকারে নানারকম দুষ্কর্ম সংঘঠিত হয়ে থাকে। যুবতীর সাথে হয়তো টাকা-পয়সা নেই। কিন্তু যা আছে তাতো টাকা-পয়সার থেকেও বড় লোভনীয় সম্পদ! তার সাথে গিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসব তেমন সাহস আমার নেই। কাজেই চিন্তাভাবনা হজম করে চুপচাপ বসে রইলাম। ভদ্রলোক কিন্তু বারবার তাকে পাকুড় পযর্ন্ত যেতে নিষেধ করছিলেন। রামপুরহাট স্টেশনে রাতে থাকার ব্যবস্থা আছে, যুবতী সেখানে থাকতে চাইলে তিনি ব্যবস্থা করে দিতে পারেন আশ্বাস দিলেন। কিন্তু যুবতী রাজি হল না। বলল, অসুবিধা হবে না। গ্রামের অনেকে রাত দশটা পযর্ন্ত পাকুড় বাজারে থাকে। কাউকে না কাউকে সাথে পেয়ে যাব।
এমনসময় লেবু চায়ের পসরা নিয়ে এক হকার এল। ভদ্রলোক যুবতীকে চা খাবে কিনা জিজ্ঞাসা করলে সে না করল। তখন তিনি এক ভাঁড় চা নিয়ে সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে টানতে শুরু করলেন। আমারও চা পানের নেশা আছে ভালো রকম। তবে লাল চা খুব একটা পছন্দ করি না। তবু এককাপ নিলাম।
- স্যার একটা কথা জানতে চাইছিলাম। এক ঢোক চা গলাধকরণ করে বললাম।
- হ্যাঁ, হ্যাঁ বল। চোখ তুলে তাকালেন তিনি আমার দিকে।
- আপনি কোথায় থাকেন?
- গোটা দুনিয়াটাই আমার বাড়ি। যখন যেখানে থাকতে মন চায়, সেখানে চলে যায়।
- না মানে! আমি জানতে চাইছিলাম আপনার বাড়ি কোথায়? বাংলা ভাষায় কথা বলছেন তখন নিশ্চয় আপনি বাঙালি?
- এই একটা দোষ তোমাদের, প্রাদেশিকতায় বিশ্বাস কর। আমি হচ্ছি বিশ্ব নাগরিক। যখন যেখানে থাকি সেই দেশের ভাষায় কথা বলি।
- কতগুলো ভাষা জানেন আপনি?
- হিসেব রাখিনি হে। আচ্ছা হিসেব করে রাখব, ফের কোনদিন দেখা হলে জেনে নিও।
ভদ্রলোকের কথা শুনে আমার ভিরমি খাবার জোগাড়। আর কথা বাড়ানো সমীচীন হবে না ভেবে চুপ করে গেলাম। তিনিও খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর নিজের থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি যেন কি কর বললে?
- আজ্ঞে আমি স্টুডেন্ট। কলেজে পড়ি।
- আমিও স্টুডেন্ট।
- কী!
- হ্যাঁ! তবে তোমাদের মতো বদ্ধ ঘরে আমার পোষায় না। গোটা পৃথিবীটাই আমার স্কুল। আর আমার শিক্ষক হল দুনিয়ার যত মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা। কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থেকে পুনরায় বললেন, আমি হলাম গিয়ে প্রকৃতির ছাত্র। পাঠ্যবই থেকে আর কতটুকু জানা যায়? প্রকৃতিকে পরিপূর্ণরূপে জানতে হলে তোমাকে ঘর ছেড়ে বেড়ুতে হবে। আচ্ছা তোমার কি জানা আছে আমাজনের গহিনে আদিম মানুষের বসতি সম্পর্কে? আমি নেতিবাচক মাথা নাড়লাম। তিনি বলতে থাকলেন, এতদিন ওদের সম্পর্কে সভ্য মানুষের কিছুই জানা ছিল না। সম্প্রতি খবর পাওয়া গেছে আমাজনের গহিন জঙ্গলে এমন কিছু জনবসতি আছে, যেখানকার বাসিন্দারা জামা-কাপড়ের ব্যবহার জানে না। শেখেনি চাকার ব্যবহার। মাছ-মাংস কাঁচা চিবিয়ে খায়।
- আপনি কখনও গিয়েছেন সেখানে?
- বছর পাঁচেক আগে ব্রাজিলের একটা টিমের সাথে জঙ্গলে গিয়েছিলাম। সেখানকার প্রচলিত লোককথায় উল্লেখ আছে বাবলা জাতীয় এক ধরণের গাছের ছাল সর্বরোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা ধরে, আর তা পাওয়া যায় আমাজনের জঙ্গলে। একটি ঔষধ প্রস্তুত কোম্পানির অর্থানুকূল্যে ওই গাছের খোঁজে পাঠানো হয়েছিল, আমি সেই টিমে ছিলাম।
- পেয়েছিলেন সেই গাছের সন্ধান?
- না। হেলিকপ্টারে চেপে জঙ্গল পরিদর্শনে গিয়ে আদিম জনবসতির সন্ধান মেলে। হেলিকপ্টার দেখে তারা গাছের ডাল, পাথরের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাড়া করেছিল।
- তারপর!
- সেখান থেকে ফিরে আমরা একটি প্রেস কনফারেন্স করে আদিম জনবসতির কথা প্রকাশ করি। অতঃপর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ওই এলাকাটিকে সংরক্ষিত ঘোষণা করেছে, ফলে ওখানে আর যাওয়া হয়নি। এমন সময় ট্রেন জোর ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কোন স্টেশন? তারপর নিজে উঠে গিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে একলাফে পূর্বস্থানে ফিরে এসে, ব্যাগটা তুলে নিয়ে হাঁটু মুড়ে সিটের তলায় ঢোকার চেষ্টা করতে লাগলেন। তাঁর এই মানসিক পরিবর্তনে বিস্মিত না হয়ে পারি না।
- কী হয়েছে স্যার? কেন আপনি অমন করছেন?
তিনি হাতজোড় করে সকলের কাছে অনুনয়-বিনয় করতে থাকেন, দয়া করে কেউ ওদের বলবেন না আমি এখানে আছি। এই বলে তিনি সিটের তলায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন। পরক্ষণে দু’জন যুবক এসে, ‘সুকোমল জেঠু। সুকোমল জেঠু। আপনি কোথায়? আমরা আপনাকে নিতে এসেছি’ বলে ডাকতে শুরু করল। এদিক-ওদিক, এমনি বাঙ্কে উঁকি মেরে দেখল তারা। শেষে সিটের তলায় কাঙ্খিত ব্যক্তিকে খুঁজে পেয়ে বলল, ছিঃ জেঠু! আপনি না একজন বিখ্যাত মানুষ, চারদিকে আপনার কত নাম। আপনি কিনা ট্রেনের সিটের তলায় শুয়ে আছেন। বেরিয়ে আসুন, আপনার জন্য স্টেশনের বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রলোক বাধ্য ছেলের মতো সিটের তলা থেকে বেরিয়ে এলেন। দু’হাত দিয়ে জামা-কাপড়ে লেগে থাকা ধুলোময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, তোমরা কথা দাও আমাকে বেঁধে রাখবে না।
- আপনি যা চাইবেন তাই হবে জেঠু। এক যুবক বলল। অপর জন তাঁকে একহাতে জড়িয়ে ধরে ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
- ঘটনা কী দাদা! আমার কৌতুহল নিবারন করে প্রথমজন বলল, মাথাটা গেছে। এবার আমার মাথা ঘোরার পালা। পাগল এমন মানবিক হয়? পাগলে এমন জ্ঞানগর্ভ কথা বলতে পারে? কী জানি, আমাজনের গহিন জঙ্গলে অবস্থিত আদিম সভ্যতার মতো এটাও হয়তো একটি অতিপ্রাকৃত ঘটনা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct