ভারতে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ দিয়ে নতুন বছর শুরু হয়েছে। ১ জানুয়ারি ‘বুল্লি বাই’ নামের একটি নিলাম অ্যাপে আপলোড করা শতাধিক মুসলমান নারীর ছবি দেখা গেল। ওই ছবির পাশে ঘোষণা ছিল, ‘রক্ষিতা হিসেবে বিক্রয় হবে’। যাঁদের ছবি সেখানে আপলোড করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে প্রখ্যাত অনেক সাংবাদিক, অভিনেত্রী ও অধিকারকর্মীর ছবি ছিল। সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করতেই তাঁদের ‘বিক্রি’ করার এই বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে, যা ২০ কোটি মুসলমানকে ক্ষুব্ধ করেছে। এ নিয়ে লিখেছেন অপূর্বানন্দ আজ শেষ কিস্তি।
খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ
টাকাপয়সা দিয়ে গরিব হিন্দু এবং আদিবাসীদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করছে, এমন অভিযোগ তুলে বেশ কয়েকটি রাজ্যে ইতিমধ্যে ধর্মান্তর নিষিদ্ধ করে আইন পাস করা হয়েছে। এটি খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একটি বিদ্বেষপূর্ণ ভাষ্য তৈরি করছে। কয়েকটি গির্জায় রোববারের প্রার্থনার সময় হামলা এবং যাজকদের মারধর করার ঘটনা ঘটেছে। বর্ষীয়ান সাংবাদিক জন দয়ালের গত মাসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বড়দিনে ভারতে কমপক্ষে ১৬টি শহরে গির্জায় উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা হামলা চালিয়েছে।’ উত্তর ভারতের হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ ও দিল্লি থেকে দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক পর্যন্ত প্রায় সবখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ইউনাইটেড ফোরামের হিসাবমতে, গত বছর ভারতে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ওপর কমপক্ষে ৪৬০টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২০২১ সাল ভারতের মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের জন্য আতঙ্কের বছর ছিল। নতুন বছরে সেই আতঙ্ক আরও বাড়বে বলে ধারণা করছি।
এত সব দুঃসংবাদের মধ্যে আশার কথা হলো, এসব হামলার প্রতিবাদ হতে শুরু করেছে। মুসলমান নারীরা যখন দেখলেন তাঁদের ‘বেচে দেওয়ার’ জন্য নিলামে তোলা হয়েছে, তখন তাঁরা চুপ থাকেননি। তাঁরা এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ করেছেন এবং দোষী ব্যক্তিদের সাজার আওতায় আনার দাবি তুলেছেন। প্রবল জনমতের চাপে পড়ে পুলিশ এ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েকজনকে পাকড়াও করেছে। মুসলমান সাংবাদিকদের মধ্য থেকে কয়েকজন সাহস করে নিরবচ্ছিন্নভাবে ইসলামবিদ্বেষী ঘটনার দলিলপত্র রেকর্ডে রাখছেন।
ভারতে বিজেপি সরকার ভোটের জন্য যে ধর্মীয় বিভাজন টেনে দিচ্ছে, তার বিরুদ্ধে সেখানকার ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার মানুষ এবং অনেক সাংবিধানিক কাঠামো জেগে উঠতে শুরু করেছে। যেমন সুপ্রিম কোর্ট গত সপ্তাহে ঘোষণা করেছেন, হরিদ্বারে বিদ্বেষ ছড়ানোতে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের শুনানি দ্রুততার সঙ্গে হবে। এ ছাড়া ত্রিপুরায় গত অক্টোবর-নভেম্বরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদে সেখানে কেউ কিছু বললে বা লিখলে তাঁদের হয়রানি না করতে পুলিশকে আদেশ দিয়েছেন আদালত।
২০২৪ সাল পর্যন্ত বিজেপি ক্ষমতায় থাকবে এবং মুসলমান ও খ্রিষ্টানবিরোধী প্রচার শিগগির তারা কমাবে বলে মনে হচ্ছে না। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বুঝতে পারছে, চুপ থাকা তাদের জন্য কোনো সমাধান আনবে না। ফলে তারা সাহস করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।
সুপ্রিম কোর্টের আদেশ ও মুসলমান-খ্রিষ্টানদের প্রতিবাদ ভারতে সাম্প্রদায়িক হামলার তীব্রতাকে কমিয়ে আনবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু ভারতের একার পক্ষে তার ধর্মীয় সহাবস্থানের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। এর আগে দিল্লিতে মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর প্রকাশ্যে হামলার সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেভাবে নীরবতা পালন করেছিল, তা তাদের জন্য লজ্জার। কিন্তু এখন সব পক্ষকেই বুঝতে হবে, ভারতের নাগরিকেরা যদি বিভাজিত হয়ে পড়ে, তা দেশটির গণতন্ত্রকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেবে এবং সেখানে গৃহযুদ্ধ লেগে যেতে পারে। সে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে তার আঁচ প্রতিবেশী দেশগুলোতেও লাগবে। এর মাশুল সবাইকে দিতে হবে। (সমাপ্ত...)
লেখক দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct