স্বাধীনতার স্বাধীনতা
আব্দুল মাতিন
গবেষক, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
__________________________________
এবারের স্বাধীনতার উৎসব বা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এসেছে এক ভিন্ন আবহে। ভারতবর্ষসহ সারা বিশ্বে চলমান করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হয়ে আমাদের জাতীয় অগ্রগতি কিছুটা হলেও বাধা প্রাপ্ত হয়েছে। এমনতর পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার উৎসব যতটা উৎসবমুখর ও বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপনের কথা ততটা হয়তো হচ্ছে না। তারপরেও দেখা যাচ্ছে ৭৪টি বসন্ত পেরিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার বয়স ৭৫-এ পদার্পণ করল। আজ ‘লাল কিলে পে লাল নিশান’ নয়, বরং ততস্থলে পত পত করে উড়ছে তিরঙ্গা। গেরুয়া সাদা আর সবুজ, সাথে অশোকচক্র এই তো আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক। এই তিরঙ্গায় নেই রক্ত নদীর ছাপ। আছে হাজার হাজার খেটে খাওয়া মানুষ, শ্রমিক, ও কৃষকের সংগ্রাম। যাদের রক্ত ঝড়ানো আন্দোলনের মাধ্যমে অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধিকার অর্জন করেছিল ভারতবাসী। সে এক গর্বের ইতিহাস। পাওয়া গেছিল ব্রিটিশ গোলামী থেকে মুক্তি। কিন্তু সত্যিই কি সেই স্বাধীনতা, সেই মুক্তি আমরা পেয়েছি? যার জন্য আমাদের পূর্বজগণ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন।
স্বাধীনতা চুয়াত্তোর বছর পর স্বাধীনতার দিবসে আমরা কি হলফ করে বলতে পারব, দেশের সব মানুষ দুবেলা দু’মুঠো খেতে পাচ্ছে? সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে? ইংরেজরা এদেশ থেকে বিতারিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বঞ্চনা কি বন্ধ হয়েছে? দেশের দুর্বলতর শ্রেণির অধিকারকে প্রতিষ্ঠা কী সম্ভব হয়েছে? আসলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রাপ্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সামাজিক স্বাধীনতা এখনও প্রাপ্ত হয়নি। আমাদের দেশের সংবিধান বাক স্বাধীনতা দিয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমাদের দেশে সেই বাক স্বাধীনতা শাসকের ইচ্ছাধীনে পরিণত হয়েছে। তাইতো স্বাধীন মতামত প্রাকাশের জন্য কোনো স্কলারকে জেল খাটতে হচ্ছে। বা কোনো লেখককে খুন হতে হচ্ছে। আবার কোনো সাংবাদিককে গারদে স্থান দেওয়া হচ্ছে। স্বাধীনতার এত বছর পরেও দেশের বিশেষ সম্প্রদায়কে দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। শিক্ষা থেকে আরম্ভ করে সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারের নীতি বা দেশীয় নয়, বরং দলীয় আদর্শকে বাস্তবায়ন করার প্রবল প্রয়াস চলছে। আমাদের দেশে স্বাধীন কোনোও হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করতে পারার অধিকারের স্বাধীনতা আমরা জর্জন করেছি। তাতে কোনোও সমস্যা নাই। প্রয়োজনে উপযুক্ত চিকিৎসা না দিয়ে জনগণকে খুন করার স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। তার থেকেও বড়ো স্বাধীনতা পেয়েছি সেই লাশগুলো গঙ্গার জলে ভাসিয়ো দেওয়ার স্বাধীনতা। আমরা জানতে দিইনি সঠিক চিকিৎসা পাওয়াটাও একটা স্বাধীনতা, বা স্বাস্থ পরিষেবা তাদের একটি মৌলিক অধিকার। পেয়েছি একজন পিশাচ নরপশু ধর্ষকের মুক্তির জন্য সমাবেশের স্বাধীনতা। তাইতো বলি শিক্ষা এখন আর জ্ঞানের বিষয় নয়, বরং তা হয়ে দাড়িয়েছে ক্ষমতাসীন দলের আদর্শের শিক্ষা। তাই দেশের আপামর জনতা বলতে বাধ্য হচ্ছেন, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এই স্বাধীনতা তো চাননি। তারা চেয়েছিলেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি নারগিক ও জনগণকে সমনাধিকার দিতে। প্রতিটি নাগরিকের জন্য শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলো যাতে পূরণ হয়, সেই ব্যবস্থা স্বাধীন দেশের সরকার করবে এটাই চেয়েছিলেন দেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। এবং জনগণের সকল চাহিদা যাতে পূরণ হয় সেই লক্ষ্যেই স্বাধীনতা সংগ্রামীরা জীবনকে তুচ্ছ করে আত্ম-বলিদান করেছিলেন। তাদের চাহিদা আর আত্ম-বলিদান যে সার্বিকভাবে সফল হয়নি বিনা দ্বিধায় তা বলা যায়। কেননা আজকের দেশ পরিলাকরা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নামে শপথ করেও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা নিয়মে পর্যবসিত করেছেন। তাইতো কোথাও আচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখিয়ে জনগণকে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয় হচ্ছে। আবার কোথাও শিক্ষিত যুবসমাজ তাদের ন্যয্য দাবিদাওয়া নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করলে পুলিশ বাহিনী দিয়ে রাতের আন্ধকারে তাদেরকে লাঠিপেটা করা হচ্ছে, এইতো আমাদের স্বাধীনতা। আবার দেশের সম্প্রীতিকে বিপন্ন করে বিশেষ সমাজকে অতঙ্কের মধ্যে রেখে দেওয়া হচ্ছে। কোউ যদি এ বিষয়ে মন্তব্য করে তাহলে তার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, অস্পৃশ্যতাকে আমাদের দেশের সংবিধানে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংবিধানে ও আইনের চোখে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। স্বাধীনতার এত বছর পরেও দলিত হওয়ার অপরাধে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারছে না অনেক সন্তান। বা সংখ্যালঘু হওয়ার জন্য যোগ্যতা থাকা সত্বেও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অনেকে। তাই প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করছে এই স্বাধীনতাই কি চেয়েছিলেন আমাদের দেশের মহান স্বাধীনতা সমগ্রামীরা?
বলা বাহুল্য স্বাধীনতা শব্দটির ব্যপ্তি বিশাল। স্বাধীনতা বলতে আমরা কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথা ভাবি না। আমরা ভাবি আমরা স্বাধীন দেশেই জন্মেছি। আমাদের কাছে স্বাধীনতা মানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী উপযুক্ত কর্ম করতে পারা। চোখের সামনে কোনো অসহায় মানুষ দেখলে তার দিকে সাহায্যের হাত কারোর অনুমতি ব্যাতিরেকেই বাড়িয়ে দিতে পারার মধ্যেও যে স্বাধীনতা থাকে আমরা সেই স্বাধীনতা চাই। যেখানে বিকৃত মনষ্ক মানুষ শিশু কিংবা নারীর ওপরে নির্যাতন চালায়, সেখানে স্বাধীনতা আমাদেরকে প্রতিবাদ করতে শেখায়। সেই প্রতিবাদ কোনো রাজনৈতিক নেতা বা পাড়ার প্রভাবশালী দাদার ভয়ে ভীত হয়ে না। আমাদের স্বাধীনতার অভিধান জাত-পাতের ভোদাভোদ থেকে মুক্ত। আমাদের স্বাধীনতায় চিকিৎসার নামে কোন দুঃস্থ জনকে প্রবঞ্চনার শিকারও হতে হয় না। দেশের নেতা মন্ত্রিরা জনগণের মঙ্গলের তোয়াক্কা না করে যখন যা খুশি নিয়ম আরোপ করলে আমাদের স্বাধীনতা খর্ব হয়। আমরা স্বাধীনতা মানে বুঝি সর্বস্তরে শিক্ষার ব্যাপ্তি। আমরা আমাদের স্বাধীনতায় শিশু শ্রমিক চায় না। বরং কাদা মাটি মেখে যে শিশুটি মাঠে খেলছে তার মুখের হাসিতে আমরা স্বাধীনতা দেখতে চাই।
বলা বাহুল্য মানবসমাজের হাজার হাজার বছরের পথ চলাতে ৭৫টি বছর খুব যে বড়ো সময় তা কিন্তু নয়, তবে পৃথিবীর ইতিহাসে এই এমন সময়ের ব্যবধানে কোনো কোনো জাতির অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার নজিরও রয়েছে। তাইতো মনো হয় এবার একটু বিচার বিশ্লেষণ করার সময় এসেছে, কী ছিল আমাদের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন, আর পূরণই বা হয়েছে কতটা? কোথায় আমাদের ব্যর্থতা, বর্থতার করাণগুলি কী কী? ভৌগোললিকভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের বা ভূখণ্ডের অধিকারী হওয়া যদি স্বাধীনতার অন্যতম লক্ষ্য হয়, সেটি তো চল্লিশের দশকের মাঝামাঝিতেই অর্জিত হয়েছে। তবে ভারতবর্ষের আপামর জনতার শুধু এটুকুই প্রত্যাশা ছিল না। অত্যাচারী ব্রিটিশদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে দেশে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তিসহ মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হবে- এরকমও আশা ছিল। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র মোটামোটিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে স্বাধীনতার পর দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলেও তা হোঁচট খেয়েছে বারবার। বজায় থাকেনি এর ধারাবহিকতা। ফলে আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি কাঙ্খিত গণতন্ত্র। রাজনীতিতে ঐক্যমত্যের অভাব ও অসহিষ্ণুতাও এর একটা বড়ো কারণ। অন্তত জাতীয় ইস্যগুলোতে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐক্যমত্য ও ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস থাকা দরকার। বিগত কয়েক বছরে লক্ষ্য করা গেছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থই যেনো প্রাধান্য পেয়েছে। অন্যদিকে দেশে বসবাসরত দলিত, আদিবাসী ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক জীবনধারা সরকারগুলোর ভূমিকাও হতাশাব্যঞ্জক বলা যায়। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মূল স্রোতেধারার সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে চলার গতিকে রোধ করার জন্য দেশের মৌলবাদী শক্তি ও স্বার্থাম্বেষী মহলের চেষ্টার কমতি দেখা যায়নি। এরই ফলে দেশের জাতীয় অগ্রগতি অনেক সময় মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল শক্তি। তাই বলা যায় যেদিন আমাদের দেশের মহিলারা নির্ভয়ে, স্বাছন্দে ও নিঃশঙ্ক চিত্তে রাস্তায় চলাফেরা করতে পারবেন, যেদিন নারী ও শিশুরা নির্যাতিত হবে না, যেদিন নারীরা ধর্ষিতা হবেনা, যেদিন শিক্ষিত যুবক সমাজকে চাকরির জন্য রাস্তায় নামতে হবে না, যেদিন কৃষকদের আন্দোলনের প্রয়োজন পড়বে না সেদিন হবে সত্যিকরের স্বাধীন দেশ। যেদিন আসিফা, নির্ভয়া ও প্রিয়াঙ্কারা নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারবে। সেদিন হবে আসল স্বাধীনতা। সর্বশেষে বলতে চাই, বর্তমান ভয়াবহ পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় আমাদের দেশের তথা ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী দেশের নাপীড়িত, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষকে মুক্তির দিশা জাগাবে, মানুষের অধিকার নিয়ে বাঁচে থাকার স্বপ্ন দেখার শক্তি আরও বাড়িয়ে দেবে এটাই কাম্য! স্বধীনতার ৭৫তম দিবসে বীর ও মহান স্বাধীনতা সংগ্রমী, সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষকে জানাই আন্তরিক ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct