ইসলাম চর্চিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, মর্যাদা, গাম্ভীর্য আর সম্ভ্রম সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করে তোলার অভিপ্রায়ে বর্তমান আলোচনাটির উপস্থাপনা। ‘হাফ বেকড তথাকথিত পণ্ডিতবর্গ ‘মধ্যযুগের বর্বরতা’ বলে আলটপকা মন্তব্য করে বসেন। ইসলাম ‘মিস আন্ডারস্টুড রিলিজিয়ন’ হিসেবে িচহ্নিত হয়। ক্রুশেডের কাল থেকে এই বেতমিজ অপপ্রচার চলছে। সদ্যতন সভ্যতার আলোকবর্তিকাটি ইসলাম-ই মধ্যযুগ থেকে জ্বালিয়ে রেখেছিল। চার্চ এবং যাজক সম্প্রদায়ের কুসংস্কার আর অমানবিক কার্যাদির কারণে বহু বৌদ্ধিক ব্যক্ত্বিকে তারা নির্মভাবে হত্যা করেছে। ইসলাম তার ‘আহল-ই-কলম’ (বিদ্বৎসমাজ)-কে কস্মিনকালেও বিড়ম্বিত করেনি। সর্বোত্তম পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞানের অন্তহীন বিকাশে মদদ করেছে। অত্যুজ্জ্বল এই মহত্তম বিষয়টির উপর আলোকপাত করলেন এই বঙ্গের মেধা আর মননের অন্যতম বিশিষ্ট প্রতিনিধি খাজিম আহমেদ।
নিশাপুর (নিসাবুর)-এর ওমর-আল-খৈয়ামের ব্যাপক প্রসিদ্ধি ফার্সি কবি হিসেবেই। তাঁর জীবনের সঙ্গে শরাব-সাকি, গোলাপ, বুলবুল বিস্তৃতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। এ বাবদে দুনিয়াভর বিস্তর আলোচনা হয়েছে। ততোধিক তাঁর কবিতা অনুদিত হয়েছে, বিভিন্ন ভাষায়। আমরা এখানে বিজ্ঞানী, গণিতশাস্ত্রী, জ্যোর্তিবিদ, জ্ঞানসাধক আর দার্শনিক ওমর খৈয়ামের বিস্ময়কর মেধা ও প্রতিভার পরিচয় দেওয়ার ‘কোশেশ’ করব।
খোরাসানের রাজধানী নিশাপুর। বহুবিধক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত বহু মনীষীর জন্মভূমি নিশাপুর। ইউরোপীয় আধুনিক পণ্ডিতবর্গ এই রাজধানী শহরকে প্রতিভার সূতিকাগার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক কবি ওমর খৈয়াম ১০৩৮ থেকে ১০৪৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নিশাপুরে জন্মেছিলেন। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল সেখানেই ১১২৩-২৪ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর পুরো আরবি নামঃ আবু আল্-ফাতাহ ওমর (উমর) ইবন ইব্রাহিম আল্-খায়ামি---(তাবু নির্মাতা--Tent maker), দেখুন; হিস্ট্রি অব দ্য অ্যারাবস, পৃ: ৩৭৭। সেলজুক সুলতান জালাউদ্দিন মালিক শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণায় ওমর খৈয়াম নিয়োজিত ছিলেন। মুক্তবুদ্ধির চিন্তক খৈয়াম যে প্রথম শ্রেণির অংক শাস্ত্রী এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী---তেমন বিষয়ে বহু শিক্ষিত মানুষেরও প্রাথমিক ধারণা নেই। ওমর খৈয়ামের গবেষণার ফলে নির্মিত হয়েছিল তাঁর পৃষ্ঠপোষকের নামে ক্যালেণ্ডার---আল্-তারিখ আল্-জলিলি। ইউরোপীয় পণ্ডিতবর্গ স্বীকার করেছেন, এই ক্যালেণ্ডার গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডারের চেয়ে অনেক বেশি সঠিক এবং বিজ্ঞান সম্মত।
শিক্ষা-সংস্কৃতি, জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা আর পঠন-পাঠনের কেন্দ্রভূমি নিশাপুরেই খৈয়ামের বাল্যজীবন কেটেছিল। শিক্ষার্জন---সেও নিশাপুরেই। ইমাম মওয়াফিকউদ্দিন; ওমরের যশস্বী আর সুপণ্ডিত শিক্ষক। ওমর এই মহাজনের সহযোগিতা ও সহানুভূতিতে ইসলামি ধর্মতত্ত্ব, হাদিস, আল্-কোরআন এবং ইসলামি আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন। সাহিত্য, দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন। তাঁর জীবৎকালে শ্রেষ্ঠগণিতবিদ এবং জ্যোতিবিদ রূপে তাঁর স্বীকৃতিই তাঁকে ‘হুজ্জুৎ-উল-হক’ (সত্যসন্ধানী) হিসেবে ভুবনজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছিল।
শিক্ষার শেষ দেউড়ি পেরিয়ে ওমর খৈয়াম ঘরে ফিরলেন। অর্থাভাব। জ্ঞানসাধনার পথ ছেড়ে দেবেন মনস্থির করে ফেললেন। দৈবাৎ আবু তাহির নামীয় একজন উদার হৃদয় মানুষ (নিজামউল মুলক হাসান ইবন ইশাকের দোস্ত) সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। কবি ভার্জিল যেমন পেয়েছিলেন ম্যাসিনাসকে। আবু তাহিরের পৃষ্টপোষকতায় শুরু করলেন গবেষণা। (সুলতান জালালউদ্দিন মালিক শাহের পৃষ্ঠপোষকতার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে সেটি খৈয়ামের অনেকখানি প্রতিষ্ঠার পরের বিষয়।) বিশেষত গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়েই তাঁর অনুসন্ধিৎসা দেখা গেছিল তখন। আরব জাতির জ্ঞানচর্চার আন্দোলন ( Scientific and literary progress: Intellectual Contributions) সেই সময় তুঙ্গে। এমন স্থিত-সংযত জ্ঞানচর্চার আন্দোলন কালেই ওমর খৈয়াম বৈজ্ঞানিক প্রতিভার পরিচয় রাখলেন। দীর্ঘকাল ধরে একনিষ্ঠ ও আন্তরিক গবেষণার ফল হিসেবে রচনা করলেন তাঁর বিশ্ব কাপানো ‘আল্-জাবর-ওয়াল-মোকাবলা’। (AL-ZABAR-WALL-MUQABALA). আরবের গণিতশাস্ত্রের গবেষণা গ্রন্থগুলোর শীর্ষে স্থান করে নিল---’আল্-জাবর’। ইংরিজিতে এই শাস্ত্র ‘Algebra’-নামেই পরিচিত। ওমর খৈয়ামের গবেষণার পূর্বেই তিন খণ্ডে এই শাস্ত্র রচিত হয়েছিল। প্রথম খণ্ডের নির্মাতা ছিলেন আল্-খোওয়ারেজমি। আল্-খোওয়ারেজমি ছিলেন জ্যামিতি শাস্ত্রের উদগাতা। তাকে সংস্কারের মাধ্যমে নতুন দিকদর্শন করিয়েছিলেন খৈয়াম। পণ্ডিত সজ্জনরা বলে থাকেন ওমর খৈয়াম মহাগণিতজ্ঞ ইউক্লিডের সাধনাকেও কিয়দংশ ম্লান করে দিয়েছিলেন।
ওমর খৈয়ামের সুসময় ক্রমেই এগিয়ে এল। ‘দীলদার দোস্ত’---আবু তাহির খৈয়ামকে তৎকালীন সুলতান মালিক শাহের ওয়াজির নিজামউল মুলকের সঙ্গে--‘জান-পেহচান’--করিয়ে দিলেন। প্রাজ্ঞপণ্ডিত নিজামউল মুলক খৈয়ামকে দরাজ ও প্রশস্ত সাহায্য দিলেন। নিশ্চিত জীবনে খৈয়ামের রথ ছুটে চলল। আরবি ঘোড়ার তেজোদৃপ্ত ভঙ্গিতে। কৃতজ্ঞ খৈয়াম তাঁর গবেষণাজাত গণিত শাস্ত্র উৎসর্গ করলেন আবু তাহির আর নিজামউদ্দিন মুলকের নামে। সুলতান পরমশ্রদ্ধা আর সম্মান সহকারে ‘বিদ্বান পরিষদ’-এর সম্মানিত সদস্য মনোনীত করলেন।
ওমর খৈয়ামের গণিতশাস্ত্রের পাণ্ডুলিপি (Manuscript) হলাণ্ডের লীডেন ও প্যারিসের গ্রন্থশালায় আজও সযত্নে রক্ষিত। ডাচ গণিতবিদ জেরাল্ড মুরম্যান, শেডিলো, ইতালির--লিবরি, ফরাসি বৈজ্ঞানিক এম. এফ. ওপেক; ওমর খৈয়ামের ‘আল্-জাবর’-এর ওপর বিস্তৃত কাজ করেছেন। শ্রদ্ধাভরে ‘Introduction’-এ সুখ্যাতি আর কৃতজ্ঞতায় ভরিয়ে দিয়েছেন। আরবি পাণ্ডুলিপি, ইউক্লিডের জ্যামিতির ওপর খৈয়ামের ভূমিকা সহ আলোচনার পাণ্ডুলিপি লীডেন (Leaden-University)--বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে দ্রষ্টব্য বস্তু হয়ে রয়েছে। ‘মুশকিলাত-ই হিসাব’-এর সংরক্ষণের মহা সৌভাগ্যও এই লীডেন পাঠকেন্দ্রের-ই।
জ্যোতির্বিজ্ঞানেও একটি বিশিষ্ট স্থান খৈয়ামের নামে নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত হয়ে রয়েছে। সুলতান মালিক শাহ তাঁকে ‘মুনাজ্জিম-ই-শাহি’--অভিধায় ভূষিত করেন। অর্থাৎ ‘রাজ জ্যোতির্বিজ্ঞানি ‘।
সেলজুক সুলতান মালিক শাহ ১০৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘মানমন্দির’(Observatory) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ওমর খৈয়াম ১০৭৯ খ্রিষ্টাব্দে তিন বছর অধ্যবসায় ও গবেষণার মাধ্যমে চান্দ্রমাসের পরিবর্তে সৌরমাস গণনার রীতি প্রচলন করেন। পুরাতন পঞ্জিকা বাতিল হলো। সভ্যতার ইতিহাসে এটি বিশেষ চমকপ্রদ আর চাঞ্চল্যকর ঐতিহাসিক ঘটনা। এই পঞ্জিকা ‘তারিখ ই জলালী’--নামে পরিচিত। খৈয়াম নয়া পঞ্জিকার নয়া মাসের নামকরণ করলেন ‘নওরোজ-ই-সুলতানি’। এই দুরূহ কাজের বিনিময়ে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ এসেছিল জ্ঞান সাধক ওমর-আল্-খৈয়ামের জীবনে। জ্যোতির্বিজ্ঞান-এর ওপর ‘জীচ-ই মালিকশাহী’ নামেও একটি গ্রন্থ শিক্ষার্থীদের জন্য জরুরী হয়ে উঠেছিল। ‘চহার মকালা’ নামক গ্রন্থে সৌরবিজ্ঞানের ওপর অলোকপাত করেন। অংক এবং বিজ্ঞানের নানা অংশের ওপর ব্যাপক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন। কালের অমোঘ নিয়মে তা লুপ্ত হয়ে গেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে আর রসায়ন শাস্ত্রেও তিনি পারদর্শী ছিলেন। বিজ্ঞান শাস্ত্রের বিভিন্ন শাখায় তাঁর যাতায়াত ছিল অবাধ। রাসায়নিক বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থ ‘মিজান উল-হিকাম’--বিশেষভাবে খ্যাত। এই গ্রন্থখানির পাণ্ডুলিপি রয়েছে ‘Gotha’ গ্রন্থশালায়। ‘লওয়াজিম উল্-আমকিনা’--নামক প্রকৃতি বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থে বায়ুর গতি ও চার ঋতু সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন। তাঁর অনুসন্ধিৎসা, জ্ঞানান্বেষণের স্পৃহা তাঁকে বিজ্ঞানি চেতনার দিকেই সম্পৃক্ত করে রেখেছিল। সোজাসুজি বলতে কি ‘ Relaxed’ হওয়ার জন্যই তিনি কবিতা লিখতেন। অথচ তাবৎ দুনিয়া ফিট জেরাল্ডের ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে তাঁর কবি সত্ত্বাকেই মহিমান্বিত করে তুললেন। ভাল কথা কিন্তু এটি তাঁর সঠিক পরিচয় নয়। আদতে তিনি ১০০ শতাংশই একজন বিজ্ঞানি। ‘আমকিনা’--নামক গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি রয়েছে ‘বার্লিন লাইব্রেরি’-তে।
চিকিৎসাশাস্ত্রেও তাঁর দক্ষতার সম্যক পরিচয় দৃষ্ট হয়। এ বাবদে তাঁর অতিখ্যাত গ্রন্থ ‘নুজহৎ-উল্-আরওয়া’ ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত’ History of Medicine’--নামক গ্রন্থেও খৈয়ামের চিকিৎসা শাস্ত্রে অবদানের কথা সরবে আলোচিত হয়েছে। ঐতিহাসিক হামিদুল্লাহ মুস্তাফি, জালালউদ্দিন আল্-কফতি, ওমর খৈয়ামকে তৎকালীন পণ্ডিতমহলের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে, তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, দর্শন ও বিজ্ঞানশাস্ত্রে অপ্রতিদ্ব্ন্দ্বী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ‘তারিখ-ই সুজিদা’, তারিখ-উল-হিকমা’, এবং ‘ফারদৌস-উৎ-তোওয়ারিখ’ নামক গ্রন্থসমূহে ওমর খৈয়ামের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে।
ওমর খৈয়ামের দার্শিনিক চিন্তাধারা বিপ্লবী ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল। সে সময়ে এহেন চিন্তা দুঃসাহসের কাজ। জীবনও জীবনবোধ সম্পর্কে খৈয়ামের যে ভাবনা তা ‘এপিকিউরাস’-এর সঙ্গে প্রায় মিলে যায়। অতীত বা ভবিষ্যতের কোনো পরোয়া না রাখায় হলো এই দর্শন ভাবনার বৈশিষ্ট। জীবনের সব বস্তুই অনিত্য। চিরকালীন স্থিতি সম্ভব নয়। মৃত্যুই স্বীকার্য সত্য। তাই জীবনের নানা সংকটের মধ্যেও শরাব আর শাকী-কে আমন্ত্রণ জানালেন ওমর খৈয়াম। লুট করে নাও, হরকিসিমের আনন্দ। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও এর প্রকাশ ছিল। অবশ্য জীবনের প্রতিটি স্তরে কাজের সঙ্গে একটি বিশ্বস্ত বোঝাপড়ার ওপর জোর দিয়েছিলেন ওমর। এই বোধের ফলেই তিনি জীবনে এতো সুসংহত কাজকর্ম করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এহো বাহ্য।
নিদারুণ ব্যস্ততার মধ্যেও ওমর খৈয়াম-এর জ্ঞানার্জনের স্পৃহা স্তিমিত হয়নি। অমৃত্য পড়াশোনায় তাঁর আন্তরিক আগ্রহ বিস্মিত করে। ‘ইলম্-উল-কেরাত’--(কোরআনের পর্যালোচনা ও ভাষ্য) ‘ফেকা-নহেয়া’ এবং ‘আদব’--জ্ঞানের এই শাখাগুলোতে তাঁর পারদর্শীতা ও ব্যুৎপত্তি যেমন ছিল গভীর, তেমনি আলোচনার গতিও ছিল সাবলীল। তিনি আল্-কোরআন-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার ও বিশ্লেষক। ‘কারি’ (কোরআন পাঠক) হিসেবেও তাঁর সুখ্যাতি ছিল বিভিন্ন প্রত্যন্তে ছড়িয়ে। নিখিল বিশ্বের মুসলমানরা আজও ৭ (সাত) রকম সুরে কোরআন পাঠ করেন। খৈয়াম সাত রকম সুরেই আল্-কোরআন পড়তেন। এটি খুবই সমাদৃত শিল্পকর্ম। ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত দার্শনিক আল্-গাজ্জালি-ও ওমর খৈয়ামের কোরআন পাঠের সুখ্যাতি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে করতেন। ইসলামতত্ত্ব, ইসলামি আইন সম্পর্কে তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞানের পরিচয় রেখেছিলেন। তৎকালীন আইনবেত্তা কাজি আরদুর রশিদ; ওমর খৈয়ামের মত বিরাট ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে প্রায়ই আইনের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতেন। খৈয়াম ‘রয্যাশনালিস্ট’--স্বভাবতই রক্ষণশীল ব্যক্তিরা তাঁর মতাদর্শের সমালোচনা করতেন। জীবননাশের সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছিল। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই, যখন দেখি, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তানায়কদের মধ্যে বিশিষ্টতম একজন ‘হুজ্জৎ উল্-ইসলাম হিসেবে বিবেচিত আল্-গাজ্জালি-ও, ওমর খৈয়ামের কাছে নানাবিধ বিষয়ে আলোচনার জন্য আসতেন--এমনকি শলা-ও নিতেন।
ওমর-আল্-খৈয়াম; আল্ কিন্দি, আল্-ফারাবি, ইবনে সিনা, আর ইবন রুশদ-এর মতো গ্রীকশাস্ত্র অভিনিবেশ সহকারে পড়তেন। মানসিক দিক দিয়ে এঁরা অ্যারিস্টিটলের ভাবশিষ্য ছিলেন। স্বাধীন চিন্তাকে সযত্নে লালন করতেন। আজকের তামাম বিশ্বের মুসলমানদের এঁদের কাছ থেকে শেখার বিষয়ের অন্ত নেই।
উপসংহার
জ্ঞানভাণ্ডারের মূর্ত প্রতীক ওমর খৈয়ামের জীবন সুস্থিত একটি--’কিতাব মহল’-এর মতই। সুলতান মালিক শাহ রাজসিংহাসন-এর পাশেই ‘জ্বলন্ত প্রজ্ঞা’--ওমর খৈয়ামের স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। সুসভ্য দুনিয়া-য় গ্রীক মনীষী অ্যারিস্টিটল, প্লেটো (আফলাতুন) এবং ইইক্লিডে-র নামের সঙ্গেই ওমর খৈয়ামের সুকৃতি--অবদান স্বোচ্চারিত।
পাদটীকাঃ
১. ওমর খৈয়ামের মৃত্যু সাল নিয়ে ঐতিহাসিকবর্গের মধ্যে মত বিরোধ রয়েছে। অধ্যাপক ব্রাউন ১১১৫ থেকে ১১৩৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ের কথা বলেছেন। সাধারণভাবে ১১২৩-২৪ খ্রিষ্টাব্দকেই তাঁর মৃত্যু সাল হিসেবে গণ্য করা হয়।
২. উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নানান জঞ্জাল-এর মেধ্য থেকে Fitz Gerald; ওমর খৈয়ামের ‘রুবাইয়াৎ’-এর পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করেন এবং ইংরিজিতে তার বিশ্বস্ত অনুবাদ করেন। বিস্ময়ে বিমুগ্ধ আর বিমোহিত বিশ্ব বিদ্বৎসমাজ নানান ভাষায় ‘রুবাইয়াৎ’-এর অনুবাদ করতে থাকেন। ফিটজেরাল্ড সর্বপ্রথম ইংরিজিতে অনুবাদ করেন, লণ্ডন; ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে। অত:পর ফরাসি, জর্মন, ইতালি, ড্যানিশ এবং আরবি ভাষায় অনুদিত হয়। বাংলাভাষাতেও অনুবাদের বেশ চমকপ্রদ সব--’গপ্পো’--রয়েছে। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে এই যে তিনি মূলতঃ একজন বিজ্ঞানী এবং অংকশাস্ত্রী। এটি তাঁর প্রথম সত্ত্বা। কবি জীবন তাঁর দ্বিতীয় এবং প্রচারিত সত্ত্বা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct