সুলেখা নাজনীন, কলকাতা: বাম শাসনে অবসান ঘটিয়ে রাজ্যে পরিবর্তনের সরকার গঠনের পর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংখ্যালঘু উন্নয়নে নানা পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম হল আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। মুখ্যমন্ত্রী বড় গর্ব করে বলেছিলেন এই আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় একদিন অনেক উঁচু জায়গায় পৌঁছে যাবে। তাই প্রতি বছর প্রায় শতাধিক কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে তা না যাওয়ার ফলে এখন চরম অর্থ সঙ্কটে ভুগছে। আর তাই নজিরবিহীনভাবে এই অর্থ সঙ্কটের কথা তুলে ধরে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সংগঠন রাজ্যের স্বাধীন সংখ্যালঘু বিষয়কও মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের মন্ত্রী গোলাম রব্বানির কাছে চিঠি লিখে এর বিহিত ব্যবস্থা করার আর্জি জানিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, গত অর্থ বর্ষে ১১২ কোটি বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে মাত্র ১০ কোটি দেওয়া হয়েছে। আর চলতি অর্থবর্ষে কোনও টাকাই দেওয়া হয়নি।
এটা বলতে দ্বিধা নেই রাজ্যের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি সরকারি অর্থ বরাদ্দের টাকা না পাওয়ার বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়ে মন্ত্রীকে এই চিঠি লেখা নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা।
জানা গেছে, ২৭ আগস্ট আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এবং ওয়েবকুপার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিটের প্রেসিডেন্ট পাঁচ পাতার এক চিঠি লিখেছেন রাজ্যের সংক্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষামন্ত্রী গোলাম রব্বানির কাছে। ওই চিঠিতে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে তুলে ধরা হয়েছে কীভাবে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় রাজ্য সরকারের বঞ্চনার শিকার।
ওই চিঠির প্রথমেই মন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় তার কাছে গত ৮ জুলাই আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অর্থ সঙ্কট সৃষ্টি হযেছে তার জন্য হস্তক্ষেপ করার দাবি জানিয়েছিল। তার পরে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। তিনটি বিষয় নিয়ে মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। প্রথম, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নিয়োজিত তদন্ত কমিটির ভূমিকা নিয়ে। দ্বিতীয়ত, সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিষয়ক দফতরের সঙ্গে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক লেনদেন এবং তৃতীয়ত, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য।
উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে রাজ্যের সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা িশক্ষা দফতরের তরফের অতিরিক্ত সচিব এক নোটিশে জানিয়েছিলেন, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক অনিয়ম, আর্থিক ও অ্যাকাডেমিক বিষয়ে অভিযোগের ভিত্তিতে চার সদস্যের এক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা এক মাসের মধ্যে এই কমিটি তদন্ত রিপোর্ট দেবেন। কিন্তু রাজ্য সরকারের বাজেট বরাদ্দ টাকা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পাচ্ছে কিনা কিংবা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কি তা নিয়ে কোনও উচ্চবাক্য করা হয়নি। ফলে, আলিয়ার অর্থ সংকটের বিষয়টিকে অন্যদিকে মোড় ঘুরিয়ে দিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্ত শুরু বলে অনেকে মনে করছেন।
এতদিন রাজ্যের সংখ্যালঘু দফতর ছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। বহুদিন পর সংখ্যালঘু দফতরে স্বাধীন মন্ত্রী নিয়োগ হয়েছে। সংখ্যালঘু সমাজে এর ফলে বিশেষ উন্মাদনা শুরু হয়েছে এই ভেবে যে একজন স্বাধীন মন্ত্রী পাওয়া গেল। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, আগুনের স্তূপের মধ্যে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে স্বাধীন সংখ্যালঘু মন্ত্রীকে।
সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী স্বাধীন সংখ্যালঘু দফতর ঘোষণা করার পর রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম মন্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘তোদের জন্য এবার স্বাধীন মন্ত্রী দিয়ে দিলাম’।
সেই মন্তব্যের সত্যতা যাচাই করা না হলেও এটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেকটা সহানুভূতিশীল হয়েই স্বাধীন সংখ্যালঘু মন্ত্রী নিয়োগ করেছেন। কিন্তু এবারের নির্বাচনে সংখ্যালঘুরা তাদের সমর্থন তৃণমূলের প্রতি উজাড় করে দেওয়ার পর এবার বড় আশা নিয়ে রয়েছেন, রাজ্যের সংখ্যালঘু কল্যাণে এবার হয়তো উদার হস্ত হবে রাজ্য সরকার। কিন্তু আলিয়া বিশ্ববিদ্যলয়ের অধ্যাপক সংগঠনের তরফে অভিযোগ সেই ধারণাকে বদলে দিতে শুরু করেছে।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সংগঠন রাজ্য সরকারের বাজেট বরাদ্দ অর্থ বঞ্চনা নিয়ে যা বেলেছে তা সত্যিই অবাক করার মতো। প্রতি বছর বাজেট ঘোষণার সময় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুবই তৃপ্ত বলেন, সংখ্যালঘু উন্নয়নে কি বিশাল পরিমাণ অর্থ রাজ্য সরকার বরাদ্দ করে। এমন ভূভারতে যে অন্য কোনও রাজ্য এমন অর্থ বরাদ্দ করে না সংখ্যালঘুদের জন্য তা তুলে ধরেন। মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি রাজ্যের সংখ্যালঘুদের পূর্ণ আস্থা তাকার কারণে, কোনও সময় প্রশ্ন করেনি রাজ্যের বরাদ্দ অনুযায়ী অর্থ সংখ্যালঘু কল্যাণে ব্যয় হয় কিনা। তবে, এবার সংখ্যালঘুদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মন্ত্রীকে লেখা চিঠি।
সংখ্যালঘু মন্ত্রী গোলাম রব্বানিকে লেখা চিঠিতে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানিয়েছেন, ২০২১-২২ অর্থবর্ষে রাজ্য সরকার ১১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। তার এক টাকাও আজ অবধি মেলেনি। গত অর্থবর্ষের টাকা দেওয়াও অথৈ জলে।
২০২০-২১ বর্ষে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ১১২ কোটি টাকা। সেই টাকার মাত্র ১০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। তাও আবার ‘অন্য গ্রান্টের’ প্রতিদিন খরচের ব্যয়ভার গ্রহণের জন্য। গত অর্থবর্ষে আর কোনও টাকা না পওয়া যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ল্যাবরেটরির সামগ্রী সরবারাহ করেছিল তাদের কোনও টাকা দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে, লজ্জার মুখে পড়তে হচ্ছে।
অধ্যাপকরা আরও জানিয়েছেন, তারা জানতে পেরেছেন, আজ অবধি চলতি অর্থবর্ষের ‘আদার গ্রান্ট’ মেলেনি। আরও জানতে পেরেছেন, অর্থের অভাবে নিরাপত্তা কর্মী, কিছু বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত গেস্ট টিচার এমনকী হাউসকিপিং স্টাফরাও বেতন পাননি। ফলে, আলিয়া বিশ্ববিদ্যারয়ের প্রতি রাজ্য সরকারের অর্থ বৈষমের অভিযোগ জোরকদমে উঠেছে।
অধ্যাপকরা অালিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োজিত তদন্ত কমিটির ভূমিকা নিয়েও চিঠিতে প্রশ্ন তুলেছেন। তদন্ত কমিটির সদস্যরা এমন বহু বিষয় আলিয়া বিশ্ববিদ্যারয়ের কাছে জানতে চাইছেন যা অবাস্তব। তবে, একই সঙ্গে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সাফল্য তুলে ধরা হয়েছে চিঠিতে। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কতজন পিএইচডি করেছেন, কতজন নেট, সেট, জেআপএফ পেয়েছেন তার সঙ্গে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা যে বহু উচ্চ পদস্থ ও সম্মান জনক চাকরির সুযোগ পেয়েছেন তা তুলে ধরা হয়েছে।
ফলে, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দ করা অর্থ না পাওয়ায় যে অচলবস্থা সৃষ্টি হতে চলেছে তাতে সন্দেহ নেই। এ ভাবে চলতে থাকলে অচিরেই যে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ হযে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। আর তখন তা হবে আর দেশের কাছে এক লজ্জার বিষয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct