সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ৩ কিস্তি ২
(মসলন্দপুরে নাটক প্রতিযোগিতায় পরাজয়ের পর প্রশান্ত মাষ্টারের ডাকা ঘরোয়া মজলিসে নতুন মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। সেখানেই দেখা গেছে আলিম নামে এক বৃদ্ধের উপস্থিতি। কে এই আলিম? এ উপন্যাসে দ্বান্দ্বিক সূত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? তা নিয়ে কুশিলবরা কী সকলে একমত? ভিতরে বহুজাতিক সংস্থার দেশবিরোধী কালো ছায়া দেখেও পল্লব তা কাউকে বলতে পারল না কেন? প্রশ্ন অনেক। পড়তে পড়তে উত্তরগুলো জানুন।)
সামান্য সময়ের জন্যে দেখা হলেও পরবর্তী সময়ে সেই অনুসঙ্গ প্রশান্তর জীবনে নতুন মাত্রা যুক্ত করে দিয়েছিল। সাক্ষরতা অভিযানের শিক্ষক হিসেবে নতুন অনুপ্রেরণা লাভ করতে পেরেছিলেন। ভেবেছিলেন, নিজের কর্মকাণ্ডকে আর শুধু সাক্ষরতা অভিযানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা চলবে না। পল্লব পারলে তাঁরও পারা উচিত। এভাবেই পল্লবের গুরু তার জীবনে অভিনব অনুপ্রেরণা হয়ে দেখা দিয়েছিলেন, যা ছিল মেঘলা আকাশের বুক চিরে সূর্যের সাত রঙের মতোই।
প্রশান্তর মনে নতুন প্রতিজ্ঞা। ভারতের মাটিতে বহুজাতিক কোম্পানির যত্রতত্র সুযোগ পাওয়ার কুফল নিয়ে যেখানে সেখানে নাটক মঞ্চস্থ হলে আম-মানুষ বুঝতে পারবে, কোনটা দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক, কোনটা নয়। তিনি যে একহাজার টাকা মাসে মাসে পেয়ে থাকেন, সেই উদ্দেশ্য পূরণের জন্যে তা পল্লবের হাতে তুলে দিতেও কোনো কুণ্ঠাবোধ করবেন না। এ নিয়ে পল্লবের উপর তার একটা প্রচ্ছন্ন রাগ রয়ে গেছে। এত করে বলার পরেও পল্লব খুব বেশি মনোযোগ দেখায় নি। আলোচনার আসরে প্রথমেই সেই প্রসঙ্গ তুলে প্রশান্ত মাস্টার থেমে থেমে বললেন, যত অনুরোধ করি না কেন, পল্লব তাতে কান দেবে না। এ মানসিকতা ভালো নয়। সর্বশিক্ষা অভিযানের শিক্ষক বলেই কী আমার কোনো দাম নেই?
এ সব কী বলছ মাস্টার? আমি কীসে কৃপণতা করলুম? আমাদের নাট্য আন্দোলনে তুমিই অন্যতম প্রধান প্রাণপুরুষ। তোমাকে অবহেলা করে চলার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। ব্যস্ততার মধ্যে কোনো কিছু মনে করতে না পারলে আমাকে খুলে বলতে পারো। ত্রুটি থাকলে তা অবশ্যই শুধরে নেব।
সবই মুখের কথা পল্লব। কতদিন থেকে বলছি, সাক্ষরতার উপর একটা ভালো নাটক লেখো, আজও তা কানে তুলেছ? একথা সেকথা বলে শুধু শুধু এড়িয়ে যাচ্ছ আমাকে।
প্রশান্ত মাস্টারের ন্যাকা কথায় সকলে হো হো করে হেসে উঠল। কালবৈশাখী ঝড়ের মতো তা ফেটে পড়ল আসরের মধ্যে। প্রশান্ত মাস্টারের ভিতরের আক্ষেপ চড়চড় করে বাড়ছে। চাপা স্বরে আবার বলতে শুরু করলেন, দেখছি, সকলে পল্লবের দিকেই। না হলে হেসে আমার প্রস্তাব এভাবে উড়িয়ে দিতে পারত না কেউ। পল্লব পিছনে রয়েছে বলেই সকলে এভাবে সাহস পাচ্ছে। পল্লব কেন যে আমাকে এভাবে উপহাস করতে চাচ্ছে, নিজেই তা বুঝতে পারি না।
পল্লব দাশ আবেগে দুলছিল। মাস্টারের কথাগুলো তার বুকে শক্তিশেল হয়ে বিঁধল। কয়েক পা সামনে গিয়ে প্রশান্তর দুটো হাত সজোরে চেপে ধরে বলল, জানো মাস্টার, রহমান কাকু আর তুমি মাথার উপরে রয়েছ বলেই নানা অসুবিধার মধ্যে আজও নাটক নিয়ে পড়ে থাকি। আমি তোমাকে উপেক্ষা করতে পারি? একটা সত্যি জেনে রাখো, তোমার ইচ্ছে আমি পূরণ করবই। সেদিন আর বেশি দূরে নেই।
বাহির থেকে কে একজন জোরে জোরে ডাকল, মাস্টার, ও মাস্টার, বাড়িতে আছ?
আসরের গতিতে হঠাৎ ছেদ পড়ল। সকলে হতচকিত হল, কে এমন সময়ে আসতে পারে তা নিয়ে। প্রশান্তর মধ্যে সেই ভাবনা তীব্র হয়ে উঠল।
আবার সদর গেটের বাহির থেকে ডাকাডাকির শব্দ ভেসে এল কানে। বাড়িতে আছ মাস্টার, তোমার সঙ্গে এ্ট্টু দেখা করতে আইলুম।
প্রশান্তর বুঝতে বাকি থাকল না কে এমন সময়ে তার সাথে দেখা করতে আসতে পারে। ‘আইলুম’ শব্দটা একটা পরিচিত মুখকে দুচোখের সামনে ভাসিয়ে তুলল। হন্তদন্ত হয়ে সদর গেটের সামনে গিয়ে দেখলেন, আলিমচাচা উন্মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে হতাশার ছায়া। নতুন কিছু জানার উদ্দেশ্য নিয়েই যে তার কাছে এসেছেন, তা বুঝতে প্রশান্তর এতটুকু অসুবিধা হল না। চাপা স্বরে বললেন, এত রাতে কেন? নতুন কোনো খবর আছে নাকি?
এট্টা কথা তোমার কাছে জানতে এলুম গো।
সব শুনব, আগে ভিতরে চলুন। বারান্দার উপরে পা গুটিয়ে বসুন। বাতাসে ঠান্ডা ভাব রয়েছে। রাতে না এলে ভালো করতেন। খবর দিলে তো আমি আপনার বাড়িতে যেতাম। শুধু শুধু এত কষ্ট করে....।
আলিমচাচা ভিতরে ঢুকে কয়েক পা সামনে এসে বারান্দার উপরে পাতা মাদুরে থপ্ করে বসে পড়ল। বারকয়েক বুকে হাত চাপড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
মাস্টার প্রশান্ত আতঙ্কিত হয়ে বললেন, শরীর খারাপ করেনি তো আপনার?
ও সব কিছু লয় গো মাস্টার। সন্ধি থেকে মনের ভেতরটা এত তোলপাড় করতেছি যে অস্থির হয়ে তোমার কাছে আইলুম। আমাকে এ কী বিপদের মধ্যে ফেইল্যা দিলে গো। মুক্যু ছিলুম ভালো ছিলুম, কোনো ভাবনা ছিল না মাথায়। দুচোকে সব কিছু অন্ধকার দেখতুম। তোমার জন্যেই গো মাস্টার, সেই অন্ধকার সরতি সরতি অনেক দূর চলি গেছে। দুচোকের সামনে এখন কত নতুন আলো দেখতাছি। বলোনা মাস্টার, কে আমার ছেলেডারে এমুন হেরোইনের নেশা ধরালে। এভাবে আমার কোলছাড়া কইর্যা দিলে। এখন বুজতাছি, আমার মেয়েটা কেনে দুবেলা খেতি পায় না। কেনে তার জীবনে এত অন্নের অভাব। মুক্যু থাকলে ইসব নিয়ে ভাবতে হত না মাস্টার। নেকাপড়া শিখিয়ে আমার একি সর্বনাশ কইরা দিলে গো। সন্ধি থেকে কে যেন আমার ভিতরে বার বার হাতুড়ি মারতেছে। উতলে উঠছি মন। হাতদুটো বারবার শক্ত হয়ে উঠতেছি গো। শরীরে কেমন যেন বল পাইতেছি। চোখে দেখার জন্যে এমন হচ্ছি না তো? সেই সমুদ্দিরে যদি একবার সামনে পাই, লোহাপেটা হাতদুটো দিয়ে তার গলাটা টিইপ্যা টিইপ্যা মাইর্যা ফেলুম।
আলিমচাচা আর কথা বলতে পারল না। ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।
পল্লব থ্ মেরে অনুভব করল অকালবৃদ্ধ আলিমের মনের যন্ত্রণা। একেবারে অসহায় মানুষ। শিক্ষা ছিল না বলেই একরকম অন্ধকারেই ছিল। কিন্তু সর্বশিক্ষার বিস্তার তার মধ্যে নতুন সচেতনতা এনে দিয়েছে। তাতেই তার মধ্যে কিছুটা প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। আলিমের জীবনের উত্তরণে নিজেই হতবাক। প্রশান্ত মাস্টারের উদ্যোগ জনজাগরণ তৈরিতে যে বেশ কিছুটা কাজে এসেছে, তা বুঝতে পারল পল্লব। থম হয়ে কিছু সময় বসে থাকল। আরেকবার দেখে নিল আলিম চাচাকে। তার মধ্যে পল্লব নিজের কাঙ্খিত নাট্যবিপ্লবের ধূসর ছায়া দেখতে পাচ্ছে। থেমে থেমে দীপকে বলল, এই যে আলিমচাচাকে দেখছিস, পারবি ব্যাখ্যা দিতে লোকটার ভিতরে জেগে ওঠা নতুন সত্তা নিয়ে?
দীপও পল্লবের মতো কিছুটা থমকে গিয়েছিল আলিমের আকুতি শুনে। তাকেও এক ধরণের নতুন বোধ নাড়া দিতে শুরু করেছিল। মাথা নেড়ে বলল, পারব পল্লবদা।
তাহলে বল শুনি।
এখানে আলিম চরিত্রের মধ্যে আমরা দুটো দিক দেখতে পাচ্ছি। এতদিন পলে পলে তার মধ্যে যে যন্ত্রণা তৈরি হয়েছিল, তা ছিল তুষের আগুনের মতো সুপ্ত অবস্থায়। সয়ে নেওয়া ছাড়া কোনো পথ ছিল না। বেঁধে মারলে সয় ভালোর মতো অবস্থা। কিন্তু সর্বশিক্ষা অভিযানের স্পর্শে আসার পরে তার মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়েছে। বাতাসের দোলে ছাইচাপা আগুন যেমন বাইরে বের হয়ে আসে, সর্বশিক্ষার ফলশ্রুতি তেমনি তার জীবনে নতুন চেতনা তৈরি করে দিতে পেরেছে। অন্ধকারে রয়েছে স্থবিরতা, যা পচা জল ছাড়া কিছুই নয় কিন্তু আলোর বুক জুড়ে রয়েছে প্রকাশের যন্ত্রণা যা দুর্বার গতিতে সামনে চলা জোয়ারের স্রোতের মতো। পড়াশোনার আলো তেমনি করে আলিমচাচার ভিতরের শক্তিকে অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। নতুন চেতনার আলোয় আবিষ্কার করতে পেরেছে, তাদের জীবনে দুর্ভোগের যে ছায়া তার জন্যে নিজেদের কর্মফলকে আর দায়ী করা চলে না। বরং তা অন্যের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের বোঝা হিসেবে তাদের উপর চেপে বসেছে। সেই উপলব্ধির মধ্যে রয়েছে প্রতিবাদ করার প্রাথমিক শক্তি যার জন্যে আলিমচাচার দুঃখের মধ্যেও প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের নতুন ভাষা আমরা শুনতে পাচ্ছি। সে চাচ্ছে নতুন দেওয়াল গড়ে তুলে ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে দিতে। প্রশান্ত মাস্টার তার জীবনে পথিকৃতের ভূমিকায়। সেজন্যে সে এসেছে মাস্টারের কাছে নিজের আর্তি জানাতে, মনের কথা বলে নিজেকে হাল্কা করে তুলতে। আগে যে আলিমচাচা ছাইচাপা আগুন হয়ে সময় পার করত, এখন সে বাইরের আগুন হয়ে প্রতিপক্ষকে ছ্যাকা দিতে চাচ্ছে।
ইউ আর রাইট। পল্লব হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করল দীপের সঙ্গে। আরও বলল, জেনে রাখিস, অখ্যাত গাঁয়ের এই আলিমচাচা এখানে নিজস্ব বোধশক্তির জোরে হয়ে উঠেছে এ যুগের তিতুমীর। সারা বিশ্বে শোষিত মানুষের প্রতিনিধি। এভাবেই যুগের প্রয়োজনে তিতুমীররা সমাজের বুকে ফিরে ফিরে আসে। ব্যক্তি তিতু মরে যেতে পারেন কিন্তু আদর্শমন্ডিত তিতু কখনো মরেন না। যুগ পেরিয়ে যুগান্তর হয়ে বেঁচে আছেন তিতুরা। নতুন প্রজন্মের মানুষের মধ্যে তারা ফিরে আসেন ভেঙে পড়া সমাজকে পাল্টে দিতে, চলমান সমাজ পরিকাঠামোকে নতুন রূপে গড়ে তুলতে।
দীপ অবাক হয়ে চেয়ে থাকল পল্লবের দিকে। স্তরে স্তরে জীবনের অভিজ্ঞতা তাকে অন্য পল্লবে পরিণত করে দিয়েছে। প্রতিটা ধাপে শিখেছে জীবন কীভাবে পাল্টে যায়। এভাবেই পল্লবদা চলার পথে বোধের গভীরে পৌঁছে গেছে। একটা গর্বের সুর দীপের বুকের ভিতরে, যার অর্ধেক অংশ জুড়ে রয়েছে পল্লব দাশের ইমেজ, বাকী অর্ধেক অংশ সে নিজেই। দীপ গর্বিত হল সেই সূত্র আবিষ্কার করতে পেরেছে বলেই। সে জানে, পল্লবদার অনুপ্রেরণা ছাড়া তার পক্ষে আলিমের জীবন-চেতনা নিয়ে এভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হত না। পল্লবকে উদ্দেশ্য করে বলল, তাহলে সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারলুম তো?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct