সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ২ কিস্তি ২
(মসলন্দপুরে নাটক প্রতিযোগিতায় পরাজয়ের পর প্রশান্ত মাষ্টারের ডাকা ঘরোয়া মজলিসে নতুন মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। সেখানেই দেখা গেছে আলিম নামে এক বৃদ্ধের উপস্থিতি। কে এই আলিম? এ উপন্যাসে দ্বান্দ্বিক সূত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? তা নিয়ে কুশিলবরা কী সকলে একমত? ভিতরে বহুজাতিক সংস্থার দেশবিরোধী কালো ছায়া দেখেও পল্লব তা কাউকে বলতে পারল না কেন? প্রশ্ন অনেক। পড়তে পড়তে উত্তরগুলো জানুন।)
দীপের মনে একই যন্ত্রণা। সে নিজে পারে নি সব টিকিট বিক্রি করতে। দশ টাকা পনেরো টাকার টিকিট অনেককে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দিতে পেরেছে কিন্তু পঁচিশ টাকার টিকিট কাউকে দিতে পারে নি। অম্লের ঢেকুরের মতো সেই উদ্বেগ তার ভিতর থেকে বের হয়ে আসছে। বেশি যাচাযাচিও করতে পারে নি। তখন বলছে, অত দাম দিয়ে তোমাদের নাটক দেখব কেন? পঁচিশ টাকা খরচ করে দিব্যি বড়ো দলের নাটক দেখা যায়।
এ প্রসঙ্গ দেবু মেনে নিতে পারল না। ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল, আমরা কী এমন খারাপ অভিনয় করি? যারা নিয়মিত দেখে, তাদের কাছে যথেষ্ট প্রশংসা শুনতে পাবি। সেদিন বাজারে সুবীর যেতে যেতে আমাকে বসিয়ে চা খাইয়ে কত প্রশংসাই না করল। পরে নতুন নাটক মঞ্চস্থ হলে সে কিছু আর্থিক সাহায্যও করবে বলেছে। এতেই তো অন্য কিছু প্রমাণ হয়।
সুমন বার দুই মাথা ঝাঁকালো মনের আবেগে। তারপর বলল, আসলে অভিনয়ে আমরা কতটা দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছি, তা ওই সব মানুষকে ঠিকমতো বোঝাতে পারি নি। এ দূরত্ব ঘোচাতে না পারলে নাটক নিয়ে একটা শ্রেণির বিরুপতা থেকে যাবে। আমিও বেশ কয়েকজনকে নাটক দেখার জন্যে জোর করেছি। তাদের সরাসরি মন্তব্য, না দেখে আগেভাগে বিশ্বাস করা যায় না। এতে দুটো সূত্র পেয়েছি। নিজেদের অভিনয় নিয়ে আমরা দিব্যি বাড়িয়ে বলতে পারি। আগে তাদেরকে বিনা পয়সায় দেখানো উচিত, পছন্দ হলে পরে তারা ভেবে দেখতে পারে।
আসিফ চাপা স্বরে বলল, তুই যে অভিজ্ঞতা নেওয়ার কথা ভাবছিস, তা আমার আগেই নেওয়া হয়ে গেছে। তোদেরকে না বলে টিকিটের দাম না নিয়ে অনেককেই নাটক দেখার সুযোগ করে দিয়েছি। শো ভেঙে গেলে তারা বলেছে, বেশ লাগল এ নাটক দেখতে। কিন্তু টিকিটের মূল্য দেওয়ার প্রসঙ্গটুকু সুকৌশলে এড়িয়ে গেছে। শুধু ক’টা টাকা দেওয়ার ভয়ে রাস্তা ঘাটে বাজারে যাওয়ার সময় গা লুকিয়ে সরে পড়তে দেখেছি। আরেকটা খাঁটি হিসেব দিই। গত শোতে গেঁটের টাকা খরচ করে সাত জনকে নাটক দেখিয়েছি। তাদের মন্তব্য, গ্রামের কর্মব্যস্ত মানুষকে আনন্দ দিতে এটুকু করা উচিত। তবেই নাকি মানুষ আমাদের মনে রাখবে। সামনের শোর জন্যেও কয়েকজনকে টিকিট এমনি করে দিয়েছি, জানি গাঁটি খসবে। এ সব দেখে বেশ বুঝতে পারছি, একটা বিশেষ শ্রেণির মানুষ ফকটে নাটক দেখতে চায়।।
দীপের মনে ভিন্ন একটা প্রসঙ্গ ধীরে ধীরে ধারালো ছুরি হয়ে উঠছে। নিজেও ভেবে দেখেছে, এমন হলে বেশ হয়। অনেকখানি রিলিফ পাওয়া যেতে পারে। সবার মুখের দিকে একবার আড়চোখে তাকাল। ভিতরের চনমনে ভাবনায় আরও বেশি করে তাড়িত হল। সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, জিৎ বলছিল, নতুন একটা স্পনসরশিপ পাওয়া যেতে পারে। সেই আলোচনা কতদূর এগলো তা জানতে পারলে ভিতরে ভিতরে আরেকটু ভালো অবস্থানের ভাবনায় দুলতে পারতুম।
দেবু মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। সে যেন জিৎ-এর ভাবনায় নতুন ভরসা পাচ্ছে। একা পল্লবদার পক্ষে এত খরচ টানা কিছুতেই সম্ভব নয়। অন্তত দুটো শোতে প্রায় অর্ধেক টাকা পল্লবদা নিজেই দিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে তো পল্লবদার উপর চাপ পর পর বেড়ে যাবে। একার পক্ষে এত ভার নেওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। পরের শো-এর জন্যেও নতুন কোনো আশা দেখতে পাচ্ছি না।
সুমন বলল, পল্লবদা না এলে এ আলোচনা পূর্ণতা পাবে না। জিৎ এলে তার কাছেও আমরা কিছু শুনতে পাব। এটুকু বলতে পারি, জিৎ আমাদের নাট্যসংস্থার জন্যে যেভাবে ভাবছে, তাতে ওকে প্রশংসা করতেই হয়। আমরা শুধু শুধু ভেবে কোনো সমাধানে আসতে পারব না। এখন বরং একটু রিয়ার্স করি আয়।।
আসিফ বলল, কোন নাটকের কোন অংশ ?
দেবু খুব বিরক্ত হল আসিফের উপর। ছেলেটার মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। পল্লবদাকে ওই সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করে। সেই অর্থে ওর মধ্যে ব্যর্থতার বিরুপ প্রতিক্রিয়া সকলের চেয়ে বেশি থাকার কথা, কিন্তু তা আদৌ নেই। মসলমপুরে একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতায় কেবলমাত্র আসিফের জন্যে কোনো পজিশন পাওয়া সম্ভব হয় নি। সেটাই আসিফ মাত্র কদিনে ভুলে গেল? ওখানে পজিশন পেলে সোপান-এর অবস্থান কত উপরে উঠত, সেই ভাবনাও আসিফের মাথায় নেই। বিরক্ত হয়ে বলল, হ্যারে, মসলমপুরের ঘটনাটা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি?
দীপ বলল, প্রাইজ ডিসট্রিবিউশনের দিনে আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম। সামান্যর জন্য ছিটকে গিয়েছি আমরা। পয়েন্টগুলো পর পর সাজিয়ে দিচ্ছি। মাত্র কয়েকটা নম্বরের জন্যে প্রথম না হতে পারার মতো একটা চরম দৃষ্টান্ত। ‘নাট্যসন্ধ্যা’ ৭৮, তারাই প্রথম স্থানে। ‘চলমান জীবন’ হয়েছে দ্বিতীয়, তাদের পয়েন্ট ৭১। ‘কিশলয়’ তৃতীয় স্থান পেয়েছে। তাদের সংগ্রহ ৭০, আমরা পেয়েছি সাড়ে উনসত্তর। ভাবলে শরীর শিউরে ওঠে। অনুষ্ঠানের সামনে দাঁড়িয়ে আমার পাদুটো কাঁপছিল। খুব খারাপ লাগছিল, যা বলতে পারিনি কাউকে। প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য বিভাগের অধিকর্তা আইনুল বারি। আলোচনা করার সময় তিনি খুব স্পষ্ট করেই বললেন, পল্লব দাস পরিচালিত ‘সোপান’-এর জন্যে একটা বিশেষ দুঃখ থেকে গেল। কেবলমাত্র একটা চরিত্র উতরে গেলে সোপান এ নাটক প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান পেতে পারত। তিতুমীরের ভূমিকায় ছেলেটা কেন যে একটু স্মার্ট হতে পারল না, তার কারণ খুঁজে পাই নি আমি। বীরদর্পে মঞ্চের উপরে একটু চলাফেরা করতে পারলেই কোনো সমস্যা থাকত না। তখন নাটকের ইমপ্যাক্ট অন্য মাত্রা পেত। বিচারকরা বিবেচনার সময় গুরুত্ব দিয়ে না ভেবে পারতেন না। অথচ চোখের সামনে দেখলাম, ছেলেটা নামভূমিকায় থেকেও অন্যমনস্কভাবে মঞ্চে এল আর গেল। চরিত্রের ভিতরের যন্ত্রণাকে নিজের জীবনের সাথে ঠিকমতো যোগ করতে পারল না।।
আসিফ কথাগুলো গুম হয়ে শুনল, আনমনে একটু ভাবল, তারপর আড়চোখে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকল। আলোচকের মন্তব্য যে তার মনে ধরেছে, অধোমুখে বসে থেকে তা প্রমাণ করে দিল। ভাবতে লাগল, কেবল তার জন্যে পল্লবদার স্বপ্নপূরণ হল না। লোকটা জীবনপণ করে ‘সোপান’-কে ভালোবাসে। নিজে উদ্যোগ নিয়ে তাকে এই রোলটা দিয়েছিল। প্রত্যাশা ছিল, আমি পারব তার ইচ্ছেপূরণ করতে। অনেকবার তাকে বলেছিল, না ঘাবড়ালে ঠিক পেরে যাবি। আন্তরিকতার সাথে অনুশীলন করলে একজন মানুষ যে কত বেশি পূর্ণতা পেতে পারে, অনেক উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে সে নিজেই সফল হতে পারল না। অভিনয়ের জন্যে, বিশেষ করে নামভূমিকার জন্যে ভিতর থেকে যে জোর লাগে, আসিফ নিজেই তা হারিয়ে ফেলেছিল। সেজন্যে তার পক্ষে ভালো কিছু করা সম্ভব হয় নি।
দীপ খোঁচা মারল আসিফকে, সেদিন তোর কী হয়েছিল রে?
আজও তা বুঝতে পারি নি।
এমন ভাব দেখাচ্ছিস, যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানিস নে। ভাবছিস কী, আমরা কিছুই বুঝতে পারি না। আসলে আগের দিন দেখা হয় নি, তাই মন খারাপ করে নাটকটাকে এভাবে মেরে দিলি। অথচ মুখে বলছিস, সোপান-এর জন্যে তোর ভালোবাসা সবচেয়ে বেশি। বেশ নকল যুদ্ধ শিখেছিস রে।
হেরে গিয়েছি বলে এসব বলে লজ্জা দিচ্ছিস?
কী লজ্জাবান ছেলে রে। ড্যাবা ড্যাবা চোখে একসাথে ছটা যুবতী গিলে খেতে পারিস, আর আমার কথা শুনে এমন ভাব করছিস যেন এর চেয়ে বেশি লজ্জা কোনোদিন পাস নে। ডুবে ডুবে জল খেলে কেউ না বুঝুক ঈশ্বর ঠিক জানতে পারেন। আর লজ্জা করিস নে রে কচি খোকা, রিয়ার্স শুরু কর।
সুমন সেনাপতি, আসিফ তিতুমীর।।
সেনাপতি : যুদ্ধের হানাহানিতে খুব বিচলিত হয়ে পড়েছি তিতু৷ কিছুই ভালো লাগছে না। মানুষের রক্ত নিয়ে হোলিখেলার ভিতরে কী তাৎপর্য আছে, তা বুঝতে পারি না। আমার মাথায় একটা অন্য চিন্তা খেলা করছে, ভয়ে তা বলতে পারছি নে।
তিতু : কী বলো শুনি।
ইংরেজদের সঙ্গে আপস করে নিলে অনেকেই প্রাণে বেঁচে যেতে পারত।
তা যেত। তাহলে রবি কবি ‘দুবেলা মরার আগে মরব না’ বলে কী ভুল করেছেন ? তোমার কী মনে হয়, আমরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে অন্যায়যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছি? কেন এমন ভাবছ, খুলে বললে আমার চিন্তা আরেকটু স্বচ্ছ হতে পারত।
চারদিকে দেখছি শুধু প্রাণহানির মহাপাপ। মনে হচ্ছে, তাতেই ডুবে যাচ্ছি আমরা। কার জন্যে, কীসের জন্যে এত পাপ করছি, নিজেই তা বুঝতে পারছি নে।। মৃত্যুর হোলিখেলার মধ্যে কোনো পাওনা আছে বলে আমার মনে হয় না।
পাপপুণ্যের হিসেবটা এভাবে ভাবতে নেই মাসুদ। মৃত্যুর মধ্যেও মুক্তির জয়টিকা লুকিয়ে থাকে। মুক্তির কী প্রয়োজন, সেটা না জানলে মরার হিসেবের মধ্যে পাপপুণ্যের মিথ্যে ভাবনা এভাবেই ঢুকে পড়ে। তুমি আমার প্রধান সেনাপতি। কেন এতদিন বুঝতে পারলে না আমাদের জীবনযুদ্ধের শেষ পরিণতিটুকু? একদিকে ভারতের মূল আগ্রাসনশক্তি ইংরেজ, অন্যদিকে তাদের সাথে গোপনে যুক্ত হয়েছে কিছু দেশীয় জমিদার। দুটো শক্তিই চাচ্ছে, ভারতের শাসন ক্ষমতা যেন ভারতীয়দের হাতে না থাকে। আমরা চাচ্ছি এই পথটা রুদ্ধ করে দিতে। তুমি কি সেই রাস্তার মধ্যে কোনো পাপচিন্তা দেখতে পাচ্ছ? এ পথের গতি বন্ধ করতে গেলেই প্রাণহানি ঘটবে। এ তো অন্যায় পথের সাথে ন্যায়পথের যুদ্ধ। দিনের সাথে রাত যেমন কখনো মিশে যেতে পারে না, এ দুটো পথ তেমনি কোনোদিন মিলেমিশে একাকার হতে পারে না। তোমাকে রক্ত দিয়েই দেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। এর বাইরে অন্য যে কোনো ভাবনাই পাপ এবং তা ভীরুতার জড়তায় ভরা। তুমি কী এ দেশের স্বাধীনতা চাও না? একটা সত্যি আজ জেনে রাখো, এ মুক্তি সংগ্রামে মরতে পারলে মানুষ তোমাকে শহীদের মর্যাদা দেবে। জীবনে এর চেয়ে বড়ো পাওনা আর কিছুই হতে পারে না।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct