আব্দুল মাতিন: নীল-সাদা স্ক্রিনের রঙ্গিন দুনিয়ার মোহ মানুষকে দিন দিন করে তুলেছে অন্তর্মুখী। বন্ধুদের সাথে আড্ডা কিংবা খেলাধুলোর সময়ের জায়গায় এখন হাতে উঠেছে স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ। মাঠের বিনোদন এখন ছোট যন্ত্রে বন্দি। যত্ন করে নিজের হাতে বানানো ঘুড়ি আকাশে ওড়ানোর মজা এখন শুধুই কল্পনা। বাজার থেকে কেনা লাটিম যখন ভোঁ ভোঁ শব্দে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জানান দেয় তার সুখ যারা ঘুরিয়েছে তারাই জানে। শুধু কি লাটিম ঘুরানো? একটা লাটিম কতভাবে ঘোরানো যায় তার প্রদর্শনী দেখাটাও চোখের প্রশান্তি এনে দিতো। সভ্যতার ক্রমবিকাশ আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা। তাই তো শৈশবে যে সব খেলাধুলা খেলেছিলেন আজকের বৃদ্ধরা সে সব খেলাধুলো না দেখতে পেয়ে তারাও এখন ভুলে গেছেন বহু খেলর নাম। এক সময় গ্রামের শিশু ও যুবকরা পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলায় অভ্যস্ত ছিল। তারা অবসরে গ্রামের খোলা মাঠে দলবেঁধে খেলত এসব খেলা। আর খেলাধুলার মাধ্যমে শৈশবে দুরন্তপনায় জড়িয়ে থাকতো ছেলেমেয়েরা। কিন্তু মাঠ-বিল-ঝিল হারিয়ে যাওয়া, আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া ও কালের বিবর্তনে মহাকালের ইতিহাস থেকে মুছে যেতে বসেছে এসব খেলাধুলো। গ্রামীণ খেলা আমাদের আদি ক্রীড়া সংস্কৃতি। এসব খেলাধুলা একসময় আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করত। বর্তমানে গ্রামীণ খেলা বিলুপ্ত হতে হতে আজ তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই কঠিন। খোদ আজ পাড়াগাঁয়েও সবচেয়ে বেশি প্রচলিত কবাডি, দাঁড়িয়াবান্ধা, খো খো, ডাং গুলি, কানামাছি প্রভৃতি গ্রামীণ খেলার আর তেমন প্রচলন নেই।
বিগত ক’বছর আগেও দেখা যেত গ্রামের কিশোরীরা উঠোন দখল করে খেলছে সাত চারা, গুটি, কানা মাছি প্রভৃতি খেলাধুলা। আবার খেলাধুলোতে কোনো কালেও পিছিয়ে থাকেনি গ্রাম বাংলার ছেলেরাও। তাদের খেলতে দেখা যেত হা ডু ডু, ডাং গুলি, ক্রিকেট, মারবেল ইত্যাদি। লুডু, ষোল গুটি, তিন গুটির মতো বুদ্ধির খেলাগুলো ব্যপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল বয়স্কদের হাত ধরে। অবসর সময়ে কিংবা শীতকালে রৌদ্রে বসে এসব খেলা খেলতেন তারা। জমতোও ভালো। বর্ষাকালে খোলা মাঠে কিংবা ব্যস্তহীন রাস্তায় দেখা মিলত কিশোরদের। কাদা মাটিতে হা ডু ডু কিংবা হাওয়াহীন ফুটবল খেলা জমতো সবচেয়ে বেশি। তবে খেলার চেয়ে কাদা মাখামাখি হতো উৎসাহজনক ভাবে। ঘরে ফিরে মায়েদের বকাবকিও জুটত সৌভাগ্যক্রমে। মার্বেল আর ডাং গুলি খেলা হতো শরৎ, শীত ও গ্রীষ্ম কালে। তবে ডিজিটাল যুগে এসে হারিয়ে যাতে বসেছে গ্রাম্য এইসব খেলাগুলো। গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী মানুষ ক্রমশ ভুলে গেছে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলোগুলো। সেই সব খেলার পরিবর্তে স্থান নিয়েছে অনলাইন গেম, ফেসবুকের মতো বিনোদন। তাই শিশু কিশোরেরা অবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এর ফলশ্রুতিতে বর্তমান প্রজন্মের যেমন মানসিক বিকাশ ঘটছে না, তেমন বাড়ছে স্বাস্থ্যহানীতা ও রোগব্যাধির সংখ্যা।
নিজেদের ও সন্তানদের স্বার্থেই গ্রামীণ খেলার ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা জরুরি। পড়াশুনা যেমন মানসিক বিকাশ ঘটায় তেমনি শারীরিক বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে খেলুধুলো। আগেকার দিনে গ্রামাঞ্চলে হা-ডু –ডু, কবাডি ও লাঠি খেলার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা চলত। বিভিন্ন গ্রামে এসব খেলার জমজমাট আয়োজন হতো। এসব খেলা চলাকালে শতশত মানুষের ঢল নামত খেলা প্রাঙ্গণে। অনেক খেলোয়াড় টাকার বিনিময়েও বিভিন্ন দলের হয়ে খেলত। তাতে করে ভালো খেলে যেমন টাকাসহ নানা রকম পুরস্কার মিলতো, সেই সাথে খেলোয়াড় হিসেবে এলাকায় ছড়িয়ে পড়তো তার খ্যাতি। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এ সমস্ত খেলোয়াড়দের অনেক সম্মান করতো। তবে এখন গ্রামাঞ্চলে খেলার মাঠ কমে যাওয়ায় এসব খেলা শুধুই স্মৃতি। এক সময় গ্রাম বাংলার ছেলে মেয়েরা গ্রামীণ খেলাকে প্রধান খেলা হিসেবে খেলত। কিন্তু বর্তমান সময়ের ছেলে মেয়েরা গ্রামীণ খেলার সাথে তেমন পরিচিত নয়। তারা অধিকাংশ সময় কম্পিউটার, স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক আর অনলাইন গেমস ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা বইয়ের কিছু গ্রামীণ খেলার নাম জানলেও কি ভাবে সে খেলাগুলো খেলতে হয় তার নিয়ম কানুন কিছুই জানে না।
এক সময় গ্রাম ভিত্তিক বা স্কুল ভিত্তিক আন্তঃজেলা বা উপজেলার বিভিন্ন ধরনের খেলার আয়োজন করা হতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে এ ধরনের কোনো আয়োজনও তেমন একটা করা হয় না। তাই তরুণ প্রজন্ম এখন অনলাইন গেমে মত্ত থাকে যার ফলে সমাজের মানুষের সাথে তাদের একটা দুরত্ব তৈরি হচ্ছে। এবং তারা নানা অসামাজিক কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ছে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে হয়তো অচিরেই গ্রামীণ খেলাধুলা আমাদের সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে। পরিণত হবে রুপকথার গল্পে। তবে এখনও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিলে হারিয়ে যাওয়া খেলাগুলো হয়তো অনেকটাই ফিরিয়ে আনা সম্ভব। গ্রামীণ খেলাধুলার সাথে রয়েছে আমাদের পূর্ব পুরুষদের সম্পর্ক। তাই তাদের স্মৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমাদের উচিত এ সমস্ত খেলাধুলার আয়োজন করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এর পরিচিতি ও তার সুফল লাভের জন্য আকৃষ্ট করা। আগামী প্রজন্মের চোখে থাকুক মুক্ত আকাশ, নিঃশ্বাসে থাকুক বিশুদ্ধ বাতাস, বিনোদনে থাকুক এ হারাতে বসে যাওয়া খেলাধুলোগুলি। যে দুনিয়ায় অবাধ বিচরণে পারিবারিক বন্ধনটা দৃঢ় হয় সে দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্তর্জালের রঙিন দুনিয়ায় একান্ত একাকি সময় কাটানোই একনকার প্রজন্মের মূল ভাবনা। হারিয়ে যাওয়া সেসব সোনালি দিন আর ফিরে আসবে না কখনো। একসময় বিভিন্ন খেলার নামগুলোও হারিয়ে যাবে চুড়ন্তভাবে। আমরাও আরো ডুবে যাবো নিজেদের মধ্যে। ভুলে যাবো হাসতে, আড্ডা দিতে,। কেউ মজার ছলে কোনো জেকস বললেও আমরা কোনো রকম নিজের দুনিয়া থেকে সরে এসে একটা মুচকি হাসি দিয়ে আবার ডুব দেবো নীল-সাদা স্ক্রীনের রঙ্গিন আলোয়।
____________
লেখক: গবেষক, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct