কেন বাঙালি প্রধানমন্ত্রীর দাবি উঠছে
-------------------------
রামিজ রাজা
পিএইচডি রিসার্চ স্কলার এনআইটি দুর্গাপুর
_______________________
১৭৫৭ সালে একটি ন্যক্কারজনক ষড়যন্ত্রের উপর ভর করে পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী হবার পর রবার্ট ক্লাইভ বাংলার তৎকালীন রাজধানী মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করে শহরের অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি লিখে গেছেন “লন্ডন শহরটার মতোই এ শহরটা বিশাল বিস্তৃত, জনাকীর্ণ ও সমৃদ্ধশালী, পার্থক্য শুধু এই যে, অসীম ধন সম্পত্তিশালী ব্যক্তির সংখ্যা এই শহরে লন্ডনের চাইতে বেশি!” বাংলার এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের উৎস ছিল প্রকৃতির অফুরন্ত দান এবং অন্যদিকে অখণ্ড বঙ্গবাসীর অধ্যবসায় ও দুঃসাহসিক চরিত্র । কৃষি ও শিল্পে ছিল বাংলা অগ্রণী। বাংলা ছিল ‘পৃথিবীর তাঁত ঘর’। অন্যান্য মুখ্য শিল্পের মধ্যে ছিল চিনি, লবন, শোরা, জাহাজ নির্মাণ শিল্প ইত্যাদি। ১৯৪৭ সালে প্রায় ২০০ বছরের বহিরাগত ব্রিটিশ কুশাসনের অত্যাচার থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ভারতীয় উপমহাদেশ। ভারত ভাগের নামে ব্রিটিশরা বাংলা ও পাঞ্জাব প্রভিন্সকে ভাগ করে দিয়ে যায়। ফলতঃ সৃষ্টি হয় পাকিস্তান নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের। ১৯৭১ সালে বাঙালী জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের উপর ভিত্তি করে পাকিস্তান ভেঙে আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং অখন্ড ভারতীয় উপমহাদেশ ভেঙে সৃষ্টি হয় খন্ডিত ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের। এই বিভাজনের ফলে জাতি হিসেবে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাঙালী জাতি। এবং বাংলা ভাগের ফলে ভারত রাষ্ট্রটিও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৪৭ এর আগে পর্যন্ত অবিভক্ত ভারতবর্ষের সার্বিক উন্নয়নে সর্বাধিক ভূমিকা রেখেছিল অখন্ড বাঙালি জাতি। কলকাতা ছিল অখন্ড ভারতের রাজধানী। স্বাধীনতার লড়াই থেকে শুরু করে শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, বিজ্ঞান চর্চা, সমাজ সংস্কারে ইত্যাদি ক্ষেত্রে নেতৃত্বদানে অগ্রণী ছিল বাঙালী। অতীশ দীপঙ্কর, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, রাজা রামমোহন রায়, শেরে বাংলা ফজলুল হক, শরৎচন্দ্র বসু, আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রোকেয়া, নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, তিতুমীর, বিবেকানন্দ, মাস্টারদা সূর্য সেন থেকে শুরু করে অজস্র বাঙালী ভারতবর্ষের সর্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন। প্রায় শত বৎসর পূর্বে গোপাল কৃষ্ণ গোখেল যথার্থই মন্তব্য করেছিলেন “What Bengal thinks today, India thinks tomorrow.” এহেন চিন্তাশীল বাঙালী জাতি বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলা ভাগের পরে। বাংলা ভাগের ফলে ১৫ অগাস্ট ১৯৪৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ হল ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য। জনসংখ্যার হিসাবে স্থান ছিল পঞ্চম। জনবসতির ঘনত্বে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল দ্বিতীয়, কেরালার পরেই। ১৯৫০ সালে সর্বক্ষেত্রে মোট উৎপাদনে (জিএসডিপি) পশ্চিমবঙ্গের স্থান
ছিল দ্বিতীয়, উত্তরপ্রদেশের পরেই। সেই সময় উত্তরপ্রদেশের আয়তন ছিল পশ্চিমবঙ্গের তিনগুন ও জনসংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই গুন বেশি। ১৯৫০ সালে ভারতের মোট উৎপাদনের ১৬.১% যোগাতো উত্তরপ্রদেশ। পশ্চিমবঙ্গ যোগাতো ১১.৬%, মহারাষ্ট্র যোগাতো ১১.২%, তামিলনাড়ু যোগাতো ৬.৯%।
১৯৪৯ সালে শরৎ বসু পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কঠোর সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে বলেছিলেন “পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্বই আজ বিপন্ন, তার আর্থিক সংকট বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছেছে।” আনন্দবাজার পত্রিকাগোষ্ঠীর দিল্লির ব্যুরো চিফ ও বিশেষ রাজনৈতিক সংবাদদাতা রণজিৎ রায় প্রথমে ইংরাজীতে ‘দ্য অ্যাগনি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল’ এবং পরে বাংলায় ‘ধ্বংসের পথে পশ্চিমবঙ্গ’ নামে দু’টো বই লিখেছিলেন। এই বইদুটি স্বাধীনতার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি ভারত সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণের জলজ্যান্ত স্বাক্ষ্য বহন করছে। রণজিৎবাবু তাঁর ওই দু’টি গ্রন্থে বিভিন্ন প্রামাণ্য তথ্য উদ্ধৃত করে লিখেছেন, ‘‘বিধানচন্দ্র রায়কে দক্ষ প্রশাসক বলে মনে করা হতো। কিন্তু তাঁর সময়েই রাজ্যের আর্থিক দুর্গতি তীব্র হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গকে তার সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে নিয়োজিত কেন্দ্রীয় নীতিসমূহের সর্বনাশা আঘাত তিনিও প্রতিরোধ করতে পারেননি’’ (পৃষ্ঠা ১৪৮)। বাংলার প্রতি বঞ্চনার উদাহরণ খুঁজতে গেলে সর্বপ্রথম উঠে আসে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কথা। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে খুব পরিকল্পিত ভাবে পশ্চিমবঙ্গকে আর্থিকভাবে পিছিয়ে দেওয়া হয়। প্রথম থেকে তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পশ্চিমবঙ্গ তার নায্য প্রাপ্য পায় নি। চতুর্থ পরিকল্পনায় পশ্চিম বঙ্গের জন্যে বরাদ্দ হয় ৩২২ কোটি টাকা। মহারাষ্ট্র (৮৯৮ কোটি) ও গুজরাট (৪৫৫ কোটি) পশ্চিমবঙ্গের চাইতে চারগুন টাকা (১৩৫৭ কোটি) বেশি পায়। ১৯৬১ সালে সারা ভারতের আয়করের যে হিসেব পাওয়া গেছে তাতে দেখা যাচ্ছে প্রতি ১০০ টাকা আদায়ের পরিবর্তে কেন্দ্র থেকে রাজ্য গুলো যে অংশ ফেরত পেয়েছে তাতে পশ্চিমবঙ্গ পেয়েছিল মাত্র ১৬.২টাকা। ভারতের সার্বিক উন্নয়নে সাম্য প্রতিষ্ঠার অজুহাতে অপর রাজ্যগুলো পেয়েছিল: বোম্বাই ১৯.৪টাকা, মাদ্রাজ ৪৮.৬ টাকা, পাঞ্জাব ১০৩.৬ টাকা ও বিহার ১৮২.৮ টাকা। ১৯৬১ সালে তৃতীয় অর্থকমিশনে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি আর্থিক বঞ্চনার প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের তত্ত্বাবধানে প্রস্তুত স্বারক লিপিতে বলা হয়েছিল “আমাদের মতে অর্থ কমিশনের মূল কাজ হওয়া উচিত সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্রকে যে সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে হয় সেই অনুসারে তার প্রয়োজন নির্ধারণ করা এবং সেই সমস্ত নিদৃষ্ট দায়িত্ব সুষ্ঠু ভাবে পালন করতে প্রকৃতই যে পরিমান অর্থের প্রয়োজন হয় সেই পরিমান অর্থ তাকে রাখতে দেওয়া- কেবল সেই পরিমাণ অর্থই।” লৌহ ও ইস্পাতের দর-সমতা, কয়লার পরিবহন মাশুল ও মালগাড়ি সরবরাহ সংক্রান্ত নীতি ভারতের প্রধান শিল্প রাজ্য পশ্চিমবঙ্গকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছিল পরিকল্পিতভাবে। রাজ্যের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প স্থানান্তরিত করা হয় পশ্চিম ভারতে। ১৯৫৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ ব্যবহার করেছিল ১৮১,০০০ টন ইস্পাত এবং বর্তমান মহারাষ্ট্র ও গুজরাট নিয়ে গঠিত বোম্বাই রাজ্য ব্যবহার করেছিল ১২৩,০০০ টন ইস্পাত। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের ইস্পাত ব্যবহার ছিল ৫৮০০০ টন বেশী। ১৯৭১ সালে দর-সমতা ও কয়লা পরিবহনে ভর্তুকির সুযোগ নিয়ে মহারাষ্ট্র ও গুজরাট একত্রে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ২৩৬০০০ টন বেশী ইস্পাত ব্যবহার করে। ১৯৪৭ সালে পাট রপ্তানি শুল্কে প্রাপ্য বাংলার ভাগ ৬২.৫% থেকে নামিয়ে আনা হয়েছিল ২০% এ। তুলা, তৈলবীজ প্রভৃতি শিল্পে প্রয়োজনীয় কাঁচা মালের ক্ষেত্রেও সারা ভারতে দর-সমতার দাবি বহুবার উঠেছে। ১৯৭২ সালে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় তুলার দর-সমতার জন্যে কেন্দ্রের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন। কাঁচা তুলার জন্য পশ্চিমবঙ্গকে মহারাষ্ট্র ও গুজরাট থেকে তুলা আমদানি করতে হত এবং প্রায় ১৫% অতিরিক্ত দাম পড়ত। কিন্তু এক্ষেত্রে কোন ভর্তুকি দেওয়া হয় নি। এভাবেই ভারত সরকারের বিমাতৃসুলভ ও বৈষম্যমূলক নীতির ফলে পশ্চিমবঙ্গের বস্ত্র শিল্প ও তৈল বীজ নির্ভর শিল্প পিছিয়ে গেছে। পেট্রোপণ্য ও চুনাপাথরের ক্ষেত্রেও দর-সমতা নীতি মানা হয় নি। নিজেদের চুনা পাথর ও পূর্ব ভারতের মাশুল সমীকরণ নীতির সুবিধা প্রাপ্ত কয়লার দৌলতে ভারতের সিমেন্ট কারখানাগুলো পূর্ব ভারত থেকে স্থানান্তরিত করা হল দক্ষিণ ভারতে।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ও গুজরাটের মোট আয়তন যথাক্রমে ৮৮৭৫২ বর্গকিমি ও ১৯৬০০৪ বর্গ কিমি। পশ্চিমবঙ্গে টানা তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জি। অপরদিকে গুজরাট শাসিত হয় কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির দ্বারা। বিজেপি শাসিত গুজরাট ও তৃণমূল শাসিত পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান অর্থনৈতিক খাতে তুলনা টানলে দেখা যায় যে ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ছিল ১৫ শতাংশ সেখানে গুজরাটের এই হার ছিল ১১ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গে মোট এমএসএমই ইউনিটের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৮৯ লক্ষ সেখানে গুজরাটে এই ইউনিটের সংখ্যা মাত্র ৩৩ লক্ষ। এমএসএমইতে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে কর্মসংস্থান পেয়েছেন ১.৩৩ কোটি মানুষ সেখানে গুজরাটে এই ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ৬১ লক্ষ। পশ্চিমবঙ্গে ২০২০-২১ অর্থবর্ষে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পের মোট ২৮ কোটি দিন কাজ হয়েছে যেখানে গুজরাটে কাজ হয়েছে ৩.৫ কোটি দিন। শিক্ষাখাতেও ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বরাদ্দ বাজেট (৩৭ হাজার কোটি টাকা) গুজরাটের (২৮ হাজার কোটি টাকা) থেকে বেশি। ২০১৮-১৯ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে পশ্চিমবঙ্গে মোট বিদ্যালয়ের (৯৮০০০) সংখ্যা গুজরাটের (৫৫০০০) থেকে বেশি। পশ্চিমবঙ্গে মোট সরকারি কলেজের সংখ্যাও গুজরাটের তুলনায় দেড় গুণ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে বাজেটে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে বরাদ্দ হয়েছে ৩১ হাজার কোটি টাকা সেখানে গুজরাট সরকার এই খাতে বরাদ্দ করেছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাজেটের হার পশ্চিমবঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে ৭% সেখানে গুজরাটে বৃদ্ধির হার ৪%। বর্তমানে নবজাতক শিশুদের মৃত্যুহার পশ্চিমবঙ্গে প্রতি ১০০০ এ ১৫.৫ যা গুজরাটে ২১.৮। প্রতি ১০০০ শিশুর মধ্যে শিশু মৃত্যুর হার পশ্চিমবঙ্গের (২২) তুলনায় গুজরাটে(৩১.২) অনেক বেশি। পশ্চিমবঙ্গে মোট হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা (৭৮৫৬৬) গুজরাটের (২০১৭২) তুলনায় প্রায় চারগুণ। আইন শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে ২০২০-২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে পুলিশের জন্য বরাদ্দ বাজেট ছিল ৮৩০০ কোটি টাকা সেখানে গুজরাটে পুলিশের জন্য বরাদ্দ ছিল ৬২০০ কোটি টাকা। প্রতি লাখে অপরাধের সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় গুজরাটে অনেক বেশি। পশ্চিমবঙ্গে মহিলারা অনেক বেশি সুরক্ষিত। ভারতবর্ষে মোট দুর্নীতির মামলায় পশ্চিমবঙ্গের অবদান মাত্র ০.২%, গুজরাটের ক্ষেত্রে যা ৬%। উপরোক্ত ক্ষেত্রগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে যে স্বাধীনতার পর ৭৪ বছর ধরে বঞ্চিত হতে হতেও বিজেপি শাসিত গুজরাটের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত। মমতা ব্যানার্জীর মা-মাটি-মানুষের সরকারের কাছে অনেক পিছিয়ে তথাকথিত গুজরাট মডেল। এই গুজরাট মডেলের উপর ভিত্তি করেই দিল্লীর ক্ষমতা দখল করেছিল বিজেপি। ভারতের ভূমিকন্যা বঙ্গনারী মমতা ব্যানার্জীর উন্নয়নের মডেলের কাছে গুজরাট মডেল এখন ফিকে। মমতা সরকারের একাধিক জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের ভূয়সী প্রশংসা করেছে বিশ্বব্যাংক থেকে শুরু করে ইউনিসেফের মতো আন্তর্জাতিক সংস্হা।
অপরদিকে বিজেপি শাসনাধীন ভারত ক্রমশ অবনতির দিকে এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে। সাম্প্রতিককালে নাগরিক অধিকারের ভিত্তিতে মার্কিন সংস্থা যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে ভারত সম্পর্কে লেখা হয়েছে, ‘আংশিক স্বাধীন’। বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার দেওয়ার উপর ভিত্তি করে একটি রিপোর্ট তৈরি করেছে মার্কিন সংস্থা ‘ফ্রিডম হাউজ’। এই রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ভারতে সাম্প্রতিককালে দলিত-সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ এবং বৈষম্য বেড়েছে। হেনস্থার শিকার হচ্ছেন মুক্তমনা সমালোচক ও সাংবাদিকরা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের সুনাম বারবার ক্ষুন্ন হয়েছে দিল্লি গণহত্যা, সমালোচকদের বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহ’ মামলা, নারীদের উপর অত্যাচার, বিচার ব্যবস্থার অবনতি, কোভিড নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার কারণে। ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট’-এ ১৫৬ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ২০১৫-য় ছিল ১১৭, আর ২০১৯ সালে নেমে গিয়েছে ১৪০-এ। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, চিন এই সমীক্ষায় ভারতের তুলনায় সন্তোষজনক অবস্থায় বিরাজ করছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইউপিএ সরকারের শেষ দিক (২০১১-১২) থেকে বিজেপির প্রথম দফার শেষ অংশের (২০১৮-১৯) মধ্যে শহরেই দ্বিগুণ হয়েছে বেকারত্বের হার, যা গ্রামে প্রায় তিন গুণ। ১১৭ টি রাষ্ট্রের মধ্যে পৃথিবীর খাদ্যাভাবের নিরিখে ভারতের স্থান যেখানে ২০১৪ সালে ছিল ৫৫, সেখানে ২০১৯-এর সমীক্ষায় ভারতের স্থান নেমে দাঁড়িয়েছে ১০২-এ। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল ভারতের থেকে এগিয়ে। জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট ফর উইমেন; পিস অ্যান্ড সিকিয়োরিটি-র সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ১৬৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্হান ১৩৩ । অর্থাৎ একদমই নিরাপদ নয়। ২০১৯ এ থম্পসন রয়টার্স-এর চালানো সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, ভারত বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক বিপজ্জনক এলাকা। শুধু বিদেশি প্রতিষ্ঠানই নয়, ভারত সরকারের নিজস্ব ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর (এনসিআরবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭তে ভারতে ৩৩৬০০ জন মহিলা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এক্ষেত্রে ১৫৩টি দেশের মধ্যে ভারত ১১২তম স্হানে। বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কার অবস্থা ভারতের চেয়ে ভাল। মোদী জমানায় কৃষক আন্দোলন, এন আরসি ও সিএএ আন্দোলনকে কেন্দ্র করেও বিশ্ব বাজারে বারবার মুখ পুড়েছে ভারতবর্ষের। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজ়েশনের মতে পরিবেশ দূষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে শিশুমৃত্যু। আইকিউ এয়ার ভিসুয়াল (২০১৮) রিপোর্টে প্রকাশ বিশ্বের ৩০টি শহরের মধ্যে বায়ু দূষণে আক্রান্ত ভারতের ২২টি শহর। ভারতে ৫ বছরের কমবয়সি প্রায় এক লক্ষ শিশু প্রতি বছর মারা যায় পরিবেশ দূষণের কারণে। বিজেপি শাসিত ভারতবর্ষে কোভিড মৃত্যু বেড়েই চলেছে। নদীতে মৃতদেহ ভেসে থাকতে দেখা যাচ্ছে।কোভিড ভ্যাক্সিনেসন নিয়েও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত সন্তুষ্ট নয় মোদি সরকারের কর্মকাণ্ডে। ভারতবর্ষের সংবিধানের ‘ফেডারেল স্ট্রাকচার’ ধুঁকছে। রাজ্যগুলো প্রায়ই কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ আচরণের নিন্দা করছে।
এমতাবস্থায় ভারতের অখণ্ডতাকে রক্ষা করতে ও ভারতকে আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন ফিরিয়ে দিয়ে ভারতের পুনর্নবজাগরনের কাণ্ডারী একমাত্র বঙ্গনারী মমতা ব্যানার্জীই হতে পারেন। একজন বাঙালী নারীই পারে ভারতকে আবার পুনর্গঠন করতে যেভাবে আরেক বীর বাঙালী সৌরভ গাঙ্গুলী ক্রিকেট জুয়াই আক্রান্ত ভারতের ক্রিকেট টিমের পুনর্গঠন করেছিলেন। তাই রাষ্ট্রজুড়ে একটাই দাবি ধ্বনিত হওয়া চায় - “বাঙালী প্রধানমন্ত্রী চাই।” হয়তো ২০২৪এ ভারত পেতে পারে ইন্দিরা গান্ধীর পরে দ্বিতীয় নারী ও প্রথম বাঙালী প্রধানমন্ত্রী।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct