ডাক
হুসাইন হাসিম আনসারী
______________________
জীবনের শেষ দিন গুলি নিরালায় কাটাবেন বলে দক্ষিণ কলকাতার হেমু অ্যাপার্টমেন্টের ছয় তলার কোণের ফ্ল্যাটটা কিনেছেন মরেশ বাবু ।পশ্চিম , দক্ষিণ খোলা সুন্দর ফ্ল্যাট। বিকেলে বারান্দায় বসলে ফুরফুরে হাওয়া সঙ্গে দক্ষিণ কলকাতার অনেক অংশ দেখা যায়। বিকেলে এখানে বসেই চা পান করেন। আর অতীতের নানা স্মৃতি এসে ভীড় করে মরেশবাবুর মনে । চাকরির সূত্রে পোস্টিং ছিল বিভিন্ন জায়গায় মরেশের। দীর্ঘ তিরিশ বছরের দায়িত্বশীল ব্যস্ত জীবন। তবে এখন আর টেনশন, তেমন দায়িত্ব নিতে চান না আর তিনি। তাই রোজকার স্বাস্থ্য চর্চা সেরে উপরে এসে টিভিটা চালিয়ে দেন মরেশ বাবু। সকালের টাটকা খবর, পৃথিবী জুড়ে মরছে মানুষ বাড়ছে সংক্রমণ। আমাদের দেশের পরিস্থিতি ও ভয়াবাহ হতে চলেছে। খবরে তেমন ভালো কিছু নেই। মনটা দমে গেল তাঁর।
সংক্রমণ বেড়ে চলায় কাজের লোকের আসা বন্ধ। সিমা কাজ করতে তেমন পারে না আর। প্রথম কিছু দিন একাই সব কাজ সামলাচ্ছিলেন। যেমন রান্না, বাসন মাজা, ঘর মোছা কিছুই বাদ পড়েছিল না। অভ্যেস নেই তবে মনের জোর আছে। বাইরে বের হলে সংক্রমণ তাই ভয়ে গৃহবন্দি।ঘরে বসে থেকে যেন সময় আর কাটে না মরেশের । কিছু দিন পর আমিও (মরেশ) সিমার সঙ্গে ঘরের নানা কাজে সাহায্য করতে শুরু করলাম, কী আর করার! হয়তো সিমা মুখে বলতে সাহস হচ্ছিল না ! তবে ঘরের কাজে আমাকে হাত লাগাতে দেখতেই সিমা বলে ওঠে ।
কাজ ভাগ করে নিলে কেমন হয় ? মরেশ ভারি গলায় বলে উঠলেন এই রে। আচ্ছা বেশ ।
এত বড় বিপদ এই দীর্ঘ জীবনে কখনও আসেনি। ছেলে মেয়েরা তেমন বাড়ি থাকেনি কোনো দিনই , বাইরে পড়া শোনা করে বাড়ি থাকছে কদিন? যে কটা দিন থাকে অতিথির মতো কাটিয়েছে। মরেশ তো জীবনের সত্তর ভাগ ই অফিস নিয়ে ব্যস্ততায় কাটিয়েছে দিন। এই বয়সে এখন ঘরের কাজ করা কী সম্ভব তবু উপায় নেই করতেই হবে। নইলে আবার কে করে দেবে আমাদের কাজ ।
দিনটিদিন দিন সংক্রমণ বেড়ে চলেছে সেই ভয়ে তেমন বাইরে বেরোয় না । আজ রবিবার, ভিড় এড়াতে সাতসকালে বাজার সেরে নেওয়ায় ভালো। তাই বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বাজার সেরে আসবার পথে এক চায়ের দোকানে বরাবরি আড্ডা মেরে বাড়ি ফেরেন । তিনি শমীন্দ্র , অতনু ও হাবিব কিন্তু সেদিন শমীন্দ্র আসেননি। তাই আর আড্ডা টা তেমন জমল না। উঠে পড়লেন সবাই। মরেশ নিজ ফ্ল্যাটে এসে ঘরের কাজে হাত লাগাল আবার। বয়স টা হয়েছে অনেক নড়াচড়া করতে একটু অসুবিধা হয় ।
সারা দিন ঘরের কাজ সামলিয়ে রাত্রে ডিনার শেষে মরেশ শোবার ঘরে ঢুকতেই পায়ে বেঁধে সুন্দর কাঁচের ফুলদানি টা চুরমার! ভাঙা টুকরো ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। সিমা ভাঙার আওয়াজ শুনেই দৌড়ে এসেছেন। “এতো করে বলি যে সাবধানে চলা ফেরা করবে , শুনলে না তো?”
মরেশ - বুঝতে পারিনি একেবারে , এমন ভাবে যে পায়ে বেঁধে পড়ে যাবে। সিমা রাগে গজগজ করছে।
তুমি কিছুই বুঝতে পারোনা , আর বুঝতে পারবেও না কোন দিন।
ঠিক সেই মুহূর্তে ফোনটা বেজে উঠল মরেশের।
অতনুর ফোন। “বলো অতনু” –“শুনেছেন শমীন্দ্রের কোভিড পজিটিভ”।
“ সে কী ? কী ভাবে হল?”
“কী জানি ! একটু আগে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে। বৌদি হোম কোয়ারেন্টাইনে। আর বাড়িতে ঢোকার গলিটা পুলিশ সিল করে দিয়েছে”।
কী সাংঘাতিক বিপদ! ওঁর ছেলে তো বাইরে। খবর দিয়েছে , কিন্তু আসতে পারবে না।
হুম। কিছু তো করার নেই। খুব অসহায় লাগছে। বলতেই লাইন টা কেটে গেল। সিমা জিজ্ঞেস করলেন, “কার কী হয়েছে?”
শমীন্দ্রের কোভিড পজিটিভ। শুনেই সিমার মুখে হতাশার ছাপ। শমীন্দ্রের বৌয়ের এর খবরে আরো মুষড়ে পড়লেন। সিমা বললেন , আমরাও তো দুজনে থাকি। ছেলে মেয়ে খবর পেলেও তো আসতে পারবে না। শমীন্দ্রের বৌয়ের যদি কিছু হয়। বলে দিশাহীন ভাবে তাকালেন। মরেশ বললেন, না হবার কিছু নেই হতেই পারে। ষাটের উপর বয়স খুব রিস্ক। আমি বরং একবার দেখে আসি। সিমা বললেন খবরদার, তুমি কোথাও যাবে না আজ থেকে। ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে আমি কথা বলে নেব। মরেশ কিছু আর বললেন না।
শোনার পর থেকে শমীন্দ্রের মুখটা কিছুতেই মন থেকে যাচ্ছে না মরেশের। চায়ের দোকানে অনেক দিন এক সঙ্গে আড্ডা মেরেছেন কত। সামাজিক দূরত্বের কোন বালাই ছিলো না । এই রোগের লক্ষণ তো কিছু দিন পর জানা যায়। তাঁর শরীরে চুপি চুপি বাসা বাঁধেনি তো? একটা আচমকা অজানা ভয় তাঁর সারা শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এক দিন আগেও কী শমীন্দ্র আন্দাজ করতে পারে ছিলেন এমন কিছু ! মানুষের জীবন তার তিল তিল করে গড়া সাজানো সংসার এতো ভঙ্গুর। ওই ফুলদানির মতো। চুরমার হবার আগের মুহূর্তেও পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। তাঁর জীবনে যেন হঠাৎ কালো রাতের আকাশ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct