দিলীপ মজুমদার: কয়েকমাস আগে শুনিয়াছিলাম সেই ডাক। ভুলিতে পারি নাই। ভোলা যায় না সে ডাক, কানের ভিতর দিয়া মরমে প্রবেশ করিয়াছিল। দিদি—অ –দিদি। কি মধুর সেই ডাক। মনে হইয়াছিল বক্তা বুঝি তাঁহার শোলোক বলা কাজলা দিদিকে খুঁজিতেছেন। দিদি—অ—দিদি। সে ডাক ছড়াইয়া পড়িয়াছিল সমস্ত দেশে। কাজলাদিদি মরিয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু এই দিদি মরেন নাই। তোমার ডাক শুনিয়া ইনি রণং দেহি মূর্তিতে রঙ্গমঞ্চে আসিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন। দিদি-অ-দিদি। আবার যেই তুমি ডাকিলে, তখন দিদি মুখ ঝামটা দিয়া বলিলেন, দাঁড়াও তোমার নৌটাঙ্কি ঘুচাইয়া দিতেছি । শেয পর্যন্ত ঘুচিল নৌটাঙ্কি। বঙ্গদেশ হইতে সরিয়া পড়িল বর্গী। বন্ধ হইল সেই ডাক, দিদি-অ—দিদি।
কিন্তু দুষ্টু বালকেরা সেই ডাক নকল করিয়া মিম বানাইল। তুমি শুনিয়াছ কি না জানি না, কিন্তু সে ডাকও বড় মিষ্ট। তাহারা ডাকিল : দাড়ি—অ—দাড়ি। দাড়ির একটি কাহিনি আছে। আগে তোমার এরূপ দাড়ি ছিল না। বঙ্গদেশের নির্বাচনের পূর্ব তুমি নানাবিধ চিন্তা করিয়া দাড়ি রাখিলে। এরূপ দাড়ি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ছিল। কবিগুরুকে বালখিল্য বাঙালি বড় মানে। তোমার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রতিরূপ দেখিবে বাঙালি, গালি না দিয়া গলাগলি করিবে, এ কথা ভাবিয়াছিলে। ভাবিয়াছিলে তুমিই বা কম কিসে ! তিনি ছিলেন কবিগুরু। তুমি হইয়াছ বিশ্বগুরু। বিশ্বকে দিশা দেখাইতে বাহির হইয়াছ। নিত্য নতুন ফন্দি আঁটিতেছ। তাক লাগাইয়া দিতেছ ভারতবাসীকে। সীমা নাই তোমার কীর্তির। তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ।
দাড়ি—অ-দাড়ি! শুনিতে পাইতেছ কি এই অভাজনের কথা ! তোমাকে যে যাহা্ই বলুক, আমি কিন্তু বিশ্বাস করি তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি মহৎ। তা না হইলে এরূপ রূপান্তর হইল কি করিয়া ! আমেরিকান লেখক লিখিয়াছিলেন ‘প্রিন্স অ্যান্ড দ্য পপার ’। লেখকের নাম মার্ক টোয়েন। তুমি পপার হইতে প্রিন্স হইয়াছ। ইহা কী কম সাধনার বিষয় ! লেখাপড়ায় তুমি পণ্ডিত না হইতে পারো, কিন্তু তোমার সাধারণ জ্ঞান ও বাস্তববুদ্ধি প্রখর। তাই তুমি অবলীলায় উড়াইয়া দিতে পারো পণ্ডিতদের । বলিতে পারো, ‘ Hard work is more powerful than Harvard’. হার্ড ওয়ার্ক অর্থাৎ কঠিন পরিশ্রম করিয়া তো তুমি আজ দেশের সেরা মানুষ , তোমার কাছে হার্ভাডের ডিগ্রিধারীরাও তুচ্ছ হইয়া যায়।
দাড়ি-অ-দাড়ি ! একদা যে পপার অর্থাৎ ভিখারি ছিল, আজ তাহার সাজ-সজ্জায়, স্টাইলে বিশ্ববাসী বিমুগ্ধ। তোমার এক একখানি স্যুটের দাম দেড়-দুই লক্ষ টাকা । প্রেসিডেন্ট ওবামার ভারত সফরের সময় তুমি যে কোটি টাকা দামের পিন স্ট্রাইপ উলেন স্যুট পরিয়াছিলে, যাহার সমস্ত শরীরে সোনার জরিতে শতসহস্র মোদি নাম লেখা ছিল, তাহা দেখিয়া আমেরিকান প্রেসিডেন্টের তাক লাগিয়া যায়। তোমার পকেটের মঁ ব্লাঁ পেনটির দাম এক লক্ষ তিরিশ হাজার টাকা। নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের আগে তুমি এই পেন দিয়াই নির্দেশিকায় স্বাক্ষর করিয়াছিলে। তোমার কুর্তা, জ্যাকেট, পাগড়ি বর্ণবৈচিত্র্যে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমদাবাদের জেড ব্লু ফ্যাশন স্টোরের মালিক বিপিন চৌহান বলেন তিনি না কি তোমার ফ্যাশন ডিজাইনার। অবশ্য নয়াদিল্লির মানেকশ অডিটোরিয়ামে ছাত্রদের সভায় তুমি বলিয়াছ, তুমি নিজেই নিজের ফ্যাশন ডিজাইনার। মভিডোর ঘড়ি আর বুলগেরির চশমায় তুমি অনুপম হইয়া দেখা দাও। সপ্তাহে দুইবার চুল ছাঁটিতে হয় তোমাকে। যে সব বাষ্পীয়যানে তুমি ভ্রমণ করো সেগুলি হইল : মাহিন্দা স্করপিও, বি এম ডব্লু ৭, রেঞ্জ রোভার এইচ এস ই, টোয়াটো ল্যান্ড ক্রুজার, টাটা সাফারি।
গত পাঁচ বছরে তুমি ৫৮টি দেশ ভ্রমণ করিয়াছ। সেই বিদেশ সফরের ব্যয় ৫১৭ কোটি ৮২ লক্ষ টাকা। তোমার নিরাপত্তা ব্যয়ও রাজকীয়। ২০১৯-২০ অথর্বর্ষে সনিয়া গান্ধি, রাহুল গান্ধি. প্রিয়ঙ্কা ও তুমি স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপের নিরাপত্তার আওতায় ছিলে। এখন আছ শুধু তুমি। তোমার নিরাপত্তার বাজেট ৫৯২.৫৫ কোটি টাকা। প্রতিদিন তোমার নিরাপত্তার ব্যয় মাত্র ১.৫০ কোটি টাকা।
দাড়ি-অ-দাড়ি ! তোমাকে কেউ ভোগী বলিলে ভুল করিবে। বাহিরে যাহাই হউক, অন্তরে তুমি নিরাসক্ত। যেসব যোগী, হয়তো বা যোগী আদিত্যনাথও, মন না রাঙাইয়া বসন রাঙায়, তাহারা ভণ্ড। তোমার অন্তর যে বৈরাগ্যে রঞ্জিত। তাই তো তুমি ভোগের মাধ্যমে ত্যাগ করো। তাই তো দেশবাসীকে খাদ্য-বস্ত্র-টিকা- অক্সিজেনের মতো তুচ্ছ বস্তুকে উপেক্ষা করিতে আহ্বান করিতেছ।
দাড়ি-অ দাড়ি! বঙ্গদেশের দুর্জনেরা বলিতেছে তুমি নাকি একটি নির্বাচিত সরকারকে ফেলিয়া দিবার চেষ্টা করিতেছ, আইন-শৃঙ্খলাহীনতার অভিযোগে রাষ্ট্রপতি শাসনের কথা ভাবিতেছ । তুমি কি বলিবে জানি। তুমি বলিবে তোমার আমলে রাষ্ট্রপতি শাসন খুব কম বারই হইয়াছে। বলিবে, জওহরলালের আমলে ৪ বার, লালবাহাদুর শাস্ত্রীর আমলে ১ বার, ইন্দিরা গান্ধির আমলে ৩৫ +১৫ বার, মোরারজি দেশাইএর আমলে ১৬ বার, চরণ সিংএর আমলে ৪ বার, রাজীব গান্ধির আমলে ৬ বার, ভি পি সিংএর আমলে ২ বার, চন্দ্রশেখরের আমলে ৫ বার, দেবেগৌড়ার আমলে ১ বার, অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে ৫ বার, মনমোহন সিংএর আমলে ১২ বার রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হইয়াছে ; তোমার ১০ বছর শাসনে মাত্র ৩ বার। আর একটা কথা তুমি বলিবে জানি। একা একটি নারী যেভাবে তোমার মুখে ঝামা ঘষিয়া দিয়াছে, তাহার একটা প্রতিবিধান দরকার। পপার যে এখন প্রিন্স হইয়াছে, তাহার কি প্রেস্টিজ নাই?
দাড়ি-অ-দাড়ি ! কে নাকি তোমাকে একশত টাকা পাঠাইয়া দিয়াছে দাড়ি কাটিবার জন্য ! আশা করি সেই অভাজনের অনুরোধ রাখিবে । বঙ্গের নির্বাচন হইয়া গিয়াছে । আর তো রবীন্দ্রনাথ সাজিবার দায় নাই।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct