সম্প্রীতিবোধে উদ্দীপ্ত ও বহুত্ববাদের বিশ্বাসী এমন একজন পণ্ডিত-বিদ্বজ্জন হচ্ছেন আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন। তিনি ড. অমর্ত্য সেনের দাদু (অর্থাৎ তাঁর মায়ের বাবা)। তাঁর জীবন নিয়ে আলোকপাতে উঠে এসেছে নানা অনালোকিত তথ্য।
-----------------------------------
খাজিম আহমেদ
----------------------------------
হাল আমলে উদগ্র সাম্প্রদায়িকতা বাঙালি জীবনকে প্রায় বিপন্ন করে তুলেছে। বিশেষত ধর্মাশ্রয়ী ফ্যাসিবাদ যা কিনা রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা উৎসাহিত হচ্ছে, জাতির জীবনে তা ভয়ানক ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ বাঙালি জীবন কখনোই ক্ষুদ্র খণ্ডচিন্তাকে প্রশ্রয় বা প্রাধান্য দেয়নি। বস্তুত আজকের দিনে অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তার যে চিরন্তন বৈশিষ্ট্য সহিষ্ণুতার সঙ্গে সব বিষয়কে বিচার করার প্রবণতা, তাকেই উজ্জীবিত করতে হবে। হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনার ধারা সাবেক বাংলায় ক্রিয়াশীল ছিল।
সম্প্রীতিবোধে উদ্দীপ্ত জীবনের কথা বহু বাঙালি পণ্ডিত বহু আগেই আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। বহুত্ববাদের বিশ্বাসী এমন একজন পণ্ডিত-বিদ্বজ্জন হচ্ছেন ক্ষিতিমোহন সেন (২ ডিসেম্বর ১৮৮০-১২ মার্চ ১৯৬০। বাংলায় বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মুসলমান কবি সম্মানিত ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা একদা বাংলা সাহিত্যের বিকাশে সহায়তা করেছে। পণ্ডিতপ্রবর ক্ষিতিমোহন সেনের, ‘ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারা’ (১৯৩০), এবং ‘ভারতের হিন্দু মুসলমান যুক্ত সাধনা’ (১৯৪৯)নামক গ্রন্থদ্বয়ে তার বিশদ বর্ণনা বাঙালি মানসে প্রোথিত হয়ে গেছে। উনিশ শতক ‘হিন্দু অভ্যুত্থানবাদ’ আর মুসলমান সমাজের ‘ইসলামিকরণ’ উদারচেতনার মূলে সংশয় আর অবিশ্বাস ডেকে এনেছিল। তার ঐতিহাসিক ফল মারাত্মক হয়েছে। সেকথা প্রায় ৭৫ বছরে প্রমাণিত হয়ে গেছে- এমন দুঃসময়ে ক্ষিতিমোহন সেন সম্পর্কে যৎকিঞ্চিত আলোচনা করা যেতে পারে।
ক্ষিতিমোহন সেন উনিশ শতকের এক অভিজাত পরিবারের সন্তান। তাঁর জন্ম হয়েছিল শহর বেনারসে। তাঁর বাবা ভুবনমোহন সেন। তিনি পেশাগত বিচারে একজন শিক্ষিত চিকিৎসক ছিলেন। এই সম্মানিত পরিবারটির আদি বাসভূমি ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুর। ক্ষিতিমোহন সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯০২ সালে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এই সময়ে তিনি ‘শাস্ত্রী’ উপাধি অর্জন করেছিলেন। ১৯০৭ সালে দেশীয় একটি রাজার অধীনে শিক্ষাবিভাগের সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সে চাকরি পরিত্যাগ করে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মাচর্য আশ্রমে প্রিন্সিপ্যালের পদে বহাল হন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে বিশাল ভারতে আর চিন পরিভ্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে সঙ্গী হিসেবে নিয়ে গেছিলেন।
ক্ষিতিমোহন সেন বাংলার তর্ক প্ররোচক জাগরণের এক উজ্জ্বল ফসল। তিনি বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, হিন্দি, গুজরাটি, রাজস্থানি এবং ফার্সি-আরবি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি প্রতিটি ভাষায় স্বচ্ছন্দে ভাব বিনিময় করতে সমর্থ ছিলেন। তিনি মধ্যযুগের বাঙালি জীবনের সাংস্কৃতিক বিকাশের পুঙ্খানুপঙ্খ বিবরণ তাঁর সাহিত্যকর্মে প্রকাশ করেছেন। এই সমস্ত সাহিত্য নির্মাণে হিন্দু-মুসলিম বাঙালি জীবনের সদর্থক দিক এবং সম্প্রীতির বিষয়গুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। ধর্মীয় বিচারে পরস্পরবিরোধী হলেও সমাজজীবনে ঐক্য আর সংহতির যে উপাদানগুলো ছিল তা জনসমক্ষে হাজির করেছেন। এর ফলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অপরিচয়ের আড়াল দূর হতে সাহায্য করেছে। সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তি একটি বিশেষ গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে।
বড় বেদনার কথা এই যে হাল আমলে সম্প্রীতি আর মিশ্র সংস্কৃতির উপাদানগুলো প্রায় অনালোচিত থেকে যায়। ক্ষুদ্র রাজনৈতিক চিন্তা সমাজজীবনেও বড় বিপদের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। আজকের আলোচনাটিতে আমরা ‘জাস্টিস’ এবং ‘লাভ’-এর কথাতেই গুরুত্ব দিতে চাইছি। ক্ষিতিমোহন সেন সেই বিষয়টিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। শ্রী সেন সংগীত এবং আয়ুর্বেদ সম্পর্কে ব্যাপক আগ্রহ প্রকাশ করতেন। ১৯৪৬-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ‘লীলা বক্তৃতামালা’-য় অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৫৩-৫৪ সালে তিনি সাময়িক সময়ের জন্য শান্তিনিকেতনে ভাইস চ্যান্সেলর-এর দায়িত্ব বহন করেছিলেন। অর্থনীতি শাস্ত্রে ‘নোবেল লরিয়েট’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন ড. অমর্ত্য সেনের দাদু (অর্থাৎ তাঁর মায়ের বাবা)।
অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন বিস্তর বইপত্তর প্রকাশ করেছেন্ সেগুলোর একটি তালিকা এখানে উল্লেখ করে দিচ্ছি।
১. কবির (১৯১০), ২. ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারা (১৯৩০), ৩. ভারতের সংস্কৃতি (১৯৪৩), ৪. বাংলার সাধনা (১৯৪৫). ৫. যুগগুরু রামমোহন (১৯৪৫), ৬. জাতিভেদ (১৯৪৬), ৭. বাংলার বাউল (১৯৪৭), ৮. হিন্দু সংস্কৃতির স্বরূপ (১৯৪৭),
৯. ভারতের হিন্দু মুসলমান যুক্ত সাধনা (১৯৪৯), (১০) প্রাচীন ভারতের নারী (১৯৫৩), (১১) চিন্ময় বঙ্গ (১৯৫৭), (১২) সাধক ও সাধনা (২০০৩), (১৩) রবীন্দ্র প্রসঙ্গ ১৪. হিন্দুইজম (১৯৬৩) ইত্যাদি। হিন্দি আর গুজরাটি ভাষাতেও গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন। গ্রন্থের নামকরণ থেকেই বিষয়বস্তুর ইঙ্গিত পেয়ে যাই।
অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন মধ্যযুগে, সুফি সন্ত কবির যে ভালবাসার বাণী উচ্চারণ করেছিলেন তার উপর গুরুত্ব দিয়ে মানুষের প্রতি মর্যাদা আরোপের বিষয়টিতে প্রাধান্য দিয়েছেন। ভারত ইতিহাসের বহু আলোচক মধ্যযুগকে ‘মুসলিম যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করে বর্বর ও অসভ্য যুগ হিসেবে চিহ্নিত করতে চান এবং বিদ্বেষের বিষ জারিত করেন। ক্ষিতিমোহন সেন বিরলদৃষ্ট উদারতায় তাকে নস্যাৎ করেন এবং সম্প্রীতি সৌহার্দ্য আর চেনা জানার পরিধিকে প্রশস্ত করেন। বস্তুত কেশবচন্দ্র সেন, ভাই গিরীশচন্দ্র সেন, রায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেন বাঙালি জাতিকে হিন্দু মুসলমান হিসেবে ‘পৃথক’ বা ‘অপর’ হিসেবে ভাবেননি । ভাবতে শেখাননি। ক্ষিতিমোহন সেন এই ধারারই একজন নীরব সাধক।
অমর্ত্য সেনও এ ধারারই একজন উত্তরসূরী। অতি সম্প্রতি তার নানান সাক্ষাৎকারে সে কথা স্পষ্ট উচ্চারণ করেছেন। উগ্র ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ আর সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা তাঁকে ‘না পসন্দ’ তালিকার মধ্যে ফেলেছেন। ইদানীন্তনকালে বাংলার জনজীবনে এমন দুর্যোগ, সমস্ত রকমের সুনীতিগুলোকে ধস্ত করে দিচ্ছে। চিন্ময় বঙ্গ, রবীন্দ্র প্রসঙ্গ, হিন্দু ধর্ম সংস্কৃতি ইত্যাকার বিষয়গুলোতে ক্ষিতিমোহন উদার মানবতাবাদের চর্চা আর সন্ধান করেছেন। আজকের দিনেও তার মতাদর্শ পুরো প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়েছে।
শেষ কথা
ক্ষিতিমোহন সেন (শাস্ত্রী) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন্ ভারতের সভ্যতার বিকাশ হিন্দু-মুসলমান যৌথ সাধনার ফল – একথা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। মাত্র কিছুদিন আগে আনন্দবাজার পত্রিকায় ক্ষিতিমোহন সেনের দৌহিত্র অধ্যাপক অমর্ত্য সেনও একই মন্তব্য করেছেন। ড. সেন তাঁর দাদুর লিগেসি-কেই বহন করছেন।
সারা জীবনের জ্ঞানসাধনার সম্মানসূচক পুরস্কার ‘রবীন্দ্র মেমোরিয়াল গোল্ড মেডাল’ (১৯৪২), বিশ্বভারতীয়র প্রথম ‘দেশিকোত্তম’ এবং ‘মহাত্মা গান্ধি পুরস্কার’ (১৯৫৩), মুরারকা পুরস্কার (১৯৫৩) এবং ১৯৫৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ‘সরোজিনী বাসু গোল্ড মেডাল’ গ্রহণ করেন। মিশ্র সংস্কৃতির আবহমান ধারায় বিশ্বাসী এই মহৎ প্রাণ মানুষটির জীবনদীপ ১৯৬০ সালের ১২ মার্চ নির্বাপিত হয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct