ফৈয়াজ আহমেদ: পুঁতি কি আমরা সবাই জানি। নানা নকশার, নানা আকৃতির পুঁতি দিয়ে তৈরি হয় ছোট বড় গলার মালা, কানের দুল, হাতের চুড়ি বা ব্রেসলেট। এমনকি পোশাকে স্টাইলিশ ভাব আনতেও পুঁতি ব্যবহার করা হচ্ছে। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক এই সময়োপযোগী বস্তুটির জানা-অজানা নানা তথ্য।
পুঁতি হলো দুই প্রান্তে ছোট ছিদ্রবিশিষ্ট ছোট আলঙ্কারিক বস্তু, যা কাঠ, প্লাস্টিক, কাঁচসহ বিভিন্ন ধরনের উপকরণ থেকে বিভিন্ন গড়নে তৈরি করা হয়। এর দু’প্রান্তে ছিদ্র রাখা হয় সেলাই বা গাঁথুনির সুবিধার্থে। পুঁতি সাধারণত ১ মিলিমিটার থেকে ১ সেন্টিমিটার ব্যাসের হতে পারে। সাধারণত সুতা বা তারের সাহায্যে অনেকগুলো পুঁতি জুড়ে দিয়ে কাঙ্ক্ষিত অলংকার বানানো হয়ে থাকে।
অনেকেই হয়তো ভেবে থাকবে পুঁতির ব্যবহার হয়তো খুব পুরনো নয়। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা থেকে জানা গিয়েছে যে ৭৫,০০০ বছর আগেও মানুষ পুঁতি তৈরি করেছে এবং পরিধান করেছে। এতেই বোঝা যায়, পুঁতির গহনা দিয়ে হয়তো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং সামাজিক অবস্থান প্রকাশ পেত। একটা সময় ছিল যখন পুঁতিকে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
২০০৪ সালে তানজেনিয়ায় উটপাখির ডিমের খোলস থেকে বানানো একজোড়া পুঁতির সন্ধান পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকগণ। তাদের মতে, এই পুঁতিজোড়া ৭০,০০০ বছরের পুরোনো। প্রত্নতাত্ত্বিকদের বিশ্বাস, ঐ পুঁতিজোড়াই পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো পুঁতির গহনার নিদর্শন।
ইউরোপে প্রথম পুঁতির ব্যবহার ৩৮,০০০ বছর পূর্বে বলে ধারণা করা হয়। এর নমুনা পাওয়া গিয়েছে ফ্রান্সের লা কুইনায়। প্রাণীর খাঁজকাটা দাঁত এবং হাড় থেকে তৈরি পুঁতিগুলো সম্ভবত তখন পেন্ডেন্ট হিসেবে পরা হতো এবং সেই সময়ে থেকেই মানুষ কিছুটা জটিল জীবনযাপন শুরু করেছিল।
কাচের পুঁতির সৃষ্টি প্রায় ৫,০০০ বছর পূর্বে। এগুলো তৈরিতে কাচ এবং আগুনের ব্যবহার ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২৩৪০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২১৮০ অব্দ পর্যন্ত সময়ের কিছু নমুনা পাওয়া গিয়েছে মেসোপটেমিয়ায়। প্রাপ্ত নমুনা দেখে জানা গেছে, কাচের পুঁতি তৈরির সময় কাচের দন্ডকে আগুনের শিখার উপর ধরা হতো এবং নিচে একটি ধাতব শাবলের মতো যন্ত্র রাখা থাকতো। যখন কাচ গলে পড়তো তখন ধাতব যন্ত্রটি দ্বারা পেঁচিয়ে সেটিকে পুঁতির গঠন দেয়া হতো। এই প্রক্রিয়াকে বলা হতো ‘কোর-ফরমিং’।
ভেনিসে পুঁতির প্রচলন শুরু হয়েছিল মার্কো পোলোর ভ্রমণের পর থেকে। পোলো এশিয়া থেকে ফিয়ে যাবার সময় বেশ কিছু কাচের পুঁতি নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন সেখানকার কারিগরেরা নিজেরা পুঁতি তৈরির কাজ শুরু করেন। ১৯২০-৩০ সালের দিকে এই পুঁতি তৈরি করে ভেনিসের অনেক নারীর কর্মসংস্থান হয়েছিল।
খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ অব্দের কিছু পুঁতির কাজের সন্ধান মিলেছে প্রাচীন মিশরীয় সংস্কৃতিতে। ধারণা করা হয়, তারা পুঁতির ব্যবহারকে ‘সৌভাগ্যের চাবিকাঠি’ বলে মনে করতো। আদি আমেরিকানরা তাদের পূর্বপুরুষদেরকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য পুঁতি ব্যবহার করে আসছে। আবার আফ্রিকান সংস্কৃতিতে আত্মা এবং ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যম হিসেবে পুঁতি রাখতো। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন যে, পুঁতি তাদের জীবনকে আলোকিত করবে।
আফ্রিকান মাসাই সংস্কৃতিতে পুঁতির গুরুত্ব ছিল খুব বেশি। সেখানে সাধারণত পারিবারিকভাবে বিয়ের আয়োজন করা হতো। যখন বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে যেত তখন কনের মা পুঁতির একটি মালা তৈরি করে কনের গলায় পরিয়ে দিত যেটি দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে মেয়েটি বাগদত্তা। এই মালাকে ‘এঙ্গেজমেন্ট নেকলেস’ এবং যে সুতা দিয়ে গাঁথা হতো সেটিকে ‘দম্পতির যোগসূত্র’ বলা হত।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct