বারী সুমন
-----------------------
রুবিদের বাড়িটা খুব বেশি দূরে নয়। একটা ডাক দিলেই আমাদের বাড়ি থেকে শুনা যায়। রুবিদের বাড়িতে থাকার মতো একটা ঘর, একটা রান্নার ঘর বললে ঠিক হবেনা, রান্নার জায়গা। একটা ঘরেই ওরা ৫ সদস্যের পরিবার গাদাগাদি করে বসবাস করে। অবশ্য ওদের থাকার ঘরের এক কোণে একটা গরুর বাছুরেরও স্থান হয়েছে। গরীব মানুষ ওরা, ও রুবির বাবা রিকশা চালায়। মা সারাদিন এটা ওটা করে আর অন্য বাচ্চাদের সামলায়। রুবিই সবার বড়। রুবির পরে তার আরও ছোট দুই বোন রয়েছে। কুচো কুচো মেয়ে গুলো। রুবি সবে মাত্র তৃতীয় শ্রেণীতে পরে। স্কুলে ঠিকমতো যেতে পারেনা। কোনদিন ছোট বোনদের সামলাতে হয়, কোনদিন স্কুলের ড্রেস নেই বলে যেতে পারেনা। হর হামেশাই ওরা উপোস করে। ভালো খাবার খুব কমই ওদের ভাগ্যে জোটে।
গরীব হলেও মনের মধ্যে সাধতো থেকেই যায়। এবার রোজার শুরুতে বাবার কাছে বায়না ধরেছিলো গরুর গোশত দিয়ে প্রথম রোজার সেহেরি খাবে। বাবা সারাদিন হারভাঙা পরিশ্রম করেও শেষ পর্যন্ত গরুর গোশতের জোগান দিতে পারেনি। রাত দশটার পরে একটা ফার্মের মুরগি নিয়ে বাসায় ফেরে। এটা দেখেই রুবির আনন্দের সীমা নেই। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে,
-বাবা গরুর গোশত লাগতোনা, আমরার মুরগির গোশত অইলেই চলবো।
মেয়ের আড়ালে গামছা দিয়ে চোখ মুছে রহিম মিয়া।
-মেয়েটা আমার এতো ভালো! খেয়ে না খেয়ে দিন পার করে তবুও কোনদিন কোন অভিযোগ নেই।
-বাবা মেয়ের মহব্বতটা রেখে আগে হাত মুখ ধুয়ে আসেন রুবির বাপ। পাশের বাড়ির ভাবি একটা আতাফল দিয়া গেছে সেটা সবাই মিলে খাবো, রুবির মা বললো।
-যাচ্ছি রুবির মা যাচ্ছি।
রাতে আর ঘুমালোনা ওরা। রুবির মা মুরগি রান্না করতে চলে গেলো। বাবা মেয়ে বসে গল্প করছে। মসজিদে মুয়াজ্জিন সেহেরি খাওয়ার জন্য ডাকছে। তখন সবাই মিলে সেহেরি খেয়ে ঘুমাতে গেলো। প্রথম রোজা রুবিও থাকবে। ছোট মানুষ সবগুলোতো আর রাখতে পারবেনা।
পরদিন রুবির বাবা রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো, সারাদিন শেষে যা পেলো বাজার সদাই করে কিছু ইফতারিও কিনলো। প্রথম রোজা, আর মেয়েটাও ছোট মানুষ রোজা রাখছে তাই সাধ্যমতো ভালো কিছু ইফতারি নিয়ে বাড়ি ফিরলো। ইফতার করে সবাই বসে গল্প করছে। রুবির কোলে তার ছয় মাস বয়সের বোনটা, মার কাছেই বসে আছে রুবির ছোটটা। তার বয়স দুই কি আড়াই বছর হবে।
-বাবা এবার ঈদে আমাকে একটা নতুন জামা কিনে দিও! যদি বেশি কষ্ট হয় লাগবেনা। রুবি জানে পরিবারের সবার জন্য কেনাকাটা করা বাবার পক্ষে কষ্টকর। মার কাপড়টাও ছিঁড়ে গেছে কয়েক জায়গায়। বাবার লুঙ্গিটারও করুণ অবস্থা। রুবি বারবার বলছে, আমি বলছিনা আমাকে দিতে হবে যদি তুমি পারো তবেই......।
পঁচিশ রমজান পার হয়ে গেলো। রুবির বাবা অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছে। যে টাকা জমেছে তা দিয়ে ঈদের বাজার করার পর জামা কেনার টাকা থাকবেনা এটা নিশ্চিত। তবুও আল্লাহর উপর ভরসা রেখে চলতে থাকে রহিম মিয়া। সামনেতো আরও তিন-চারদিন আছে দেখা যাক কি হয়।
সেদিন সাতাশ রমজানের দিন বিকেলে রিকশা নিয়ে বেড়িয়েছে রহিম মিয়া। মাথায় একটা কথাই ঘুরে ফিরে বাজছে, “বাবা এবার ঈদে আমাকে একটা নতুন জামা কিনে দিও”। শহর থেকে কত রকমের লোকজন বাড়ি ফিরছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। সন্ধ্যার পর চৌরাস্তা থেকে একটা ভাড়া নিয়ে শহর থেকে বাহিরে একটা গ্রামে ভাড়া নিয়ে গিয়েছিলো রহিম মিয়া। লোকটাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে ভাড়া নিয়ে চলে এলো রহিম মিয়া।
শহরে আসার পর সিটের নিচ থেকে গ্যাস ম্যাচটা বাহির করতে যায় রহিম মিয়া। আর তখনি চমকে উঠে, একটা মানিব্যাগ পড়ে আছে সিটের উপর। রহিম মিয়া মানি ব্যাগের ভাঁজটা খুলতেই চোখে পড়ে ব্যাগের ভেতর অনেকগুলো টাকা রয়েছে। অনুমান করলে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজারতো হবেই। রহিমের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায় টাকা দেখে। মন থেকে বারবার কুমন্ত্রণা দিচ্ছে এইতো সুযোগ। “রহিম টাকাগুলো নিজের করে নে, এতো বড় সুযোগ আর পাবিনা”। রহিম মনের সাথে বার বার যুদ্ধ করে যাচ্ছে। “ না না এটাকা আমার না, যার টাকা তাকে ফিরিয়ে দেওয়াটাই উত্তম”। শেষ পর্যন্ত ব্যাগটাকে যত্ন করে রেখে রিকশার পেডেলে পা চালালো। সে যাচ্ছে ঐ লোকের বাড়িতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলো। রহিম গিয়ে ডাকলো লোকটিকে
-ভাই বাড়িতে আছেন?
-কে? ও ভাই আপনি? ভাড়াতো আমি দিয়ে দিয়েছি। নাকি ভাড়া কম হয়ে গেছে।
- না ভাই ভাড়া কম অয়নাই, তয় আফনের এই ব্যাগটা আমার রিকশায় ফালাইয়া গেছেন।
- আমার ব্যাগ!
- জ্বি আপনার ব্যাগ। এই নেন।
- ব্যাগ হাতে পেয়ে লোকটি অভিভূত।
“এখনও এমন লোক আছে! এতগুলো টাকা পেয়েও লোভ সামলিয়ে রাখলো। অথচ এ টাকা স্বেচ্ছায় ফেরত না দিলে কোনদিন পাওয়া সম্ভব ছিলোনা”।
ব্যাগ নিয়ে দেখলো টাকা সব ঠিক আছে, এক টাকাও এদিক সেদিক হয়নি। রহিম মিয়ার সততা দেখে লোকটি মুগ্ধ। রহিম মিয়ার সাথে কথা হয় লোকটির। তার পরিবার সম্পর্কে সব জানতে পারে। রুবির আবদারের কথাও জানতে পারলো লোকটি।
রহিমের রিকশায় উঠে বাজারে আসলো আবার। রহিমকে সাথে নিয়ে সেমাই, চিনি, গোশত, ডাল কিনল। একটা সুন্দর জামা কিনল, ছোট দুটি গেঞ্জি কিনল, সাথে একটা শাড়ি ও লুঙ্গি। রহিম তখনও কিছু বুঝতে পারেনি। সব কেনাকাটা শেষ হলে, রহিম জিজ্ঞাস করে,
-স্যার বাড়িতে দিয়া আসমু আপনারে?
-হুম, বাড়িতে যাবো, তবে আমার বাড়িতে নয়, তোমার বাড়িতে।
-স্যার যে কি কন। গরিবের লগে মজা করতাছেন?
-না না মজা করবো কেনো? সত্যিই তেমার বাড়িতে যাবো, চলো।
-সত্যিই যাবেন স্যার।
-হ্যাঁ সত্যিই।
-রহিমের রিকশায় করে রওয়ানা হলো। রাস্তায় অনেক কথা বার্তা হলো দুজনের। কথা বলতে বলতে রহিমের বাড়ি পৌঁছে গেলো। রুবিকে ডেকে আনলো। তার মা আসলো। সবাই একসাথে হলে লোকটি ব্যাগ থেকে সব বের করে রুবিদের দেয়। এসব দেখে সবাই অবাক। কেনইবা এই লোক এতকিছু দিলো। তখন বেড়িয়ে আসলো আসল রহস্য। রহিমের সততার জন্যই এই গুলো উপহার স্বরুপ লোকটি দিয়ে গেলো। রহিমের সততার কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। রহিম এখন গ্রামের গর্ব।
আজ ঈদের দিন। রুবিদের ঘরে সেমাই রান্না হচ্ছে। একটু পর গোশত পোলাও রান্না করবে। সবার গায়ে নতুন জামা। সবাই খুব খুশি। রহিমের সততার জন্যই আজ ওদের ঘরে অনেক অনেক আনন্দ। যে আনন্দ মানুষ অনেক অনেক টাকা খরচ করে পায়না। রুবির আনন্দ দেখে বাবা-মায়ের চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পরে আনন্দাশ্রু।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct