ইসহাক মাদানী: গোষ্ঠীপতি থেকে দলপতি থেকে রাষ্ট্রপতি। সরকারিভাবে পঞ্চায়েত রাজা প্রতিষ্ঠিত হলেও গ্রামে গ্রামে গোষ্ঠীপতি রাজ খতম হয়নি। ছেলেরা বিশেষ করে চৈত্র-বৈশাখ মাসে বাগানে খেলতে গিয়ে কেউ রাজা হয়, কেউ হয় মন্ত্রী, কেউ দারোগা, আর কেউ সিপাহী। খেলতে খেলতে মায়ের ডাক পড়লেই খেলার মঞ্চ ভেঙে সবাই ফিরে যায় মায়ের কাছে।ফিরেই মাকে খেলার দস্তান শোনাতে শুরু করে- মা আজ জানো -আমি আজ খেলতে গিয়ে মন্ত্রী হয়েছিলাম, কেউ বলে মা আমি দারোগা হয়েছিলাম। মা, মন্ত্রী হুকুম দিলেন এই দারোগা সিপাহীকে নিয়ে অচিন্ত্য গ্রামে যা। ভুট্টার ক্ষেত থেকে ভুট্টা চুরি হয়েছে চোর ধরে নিয়ে আয়। মা, আমি ছুটলাম সিপাহিকে নিয়ে অচিন্ত্যগ্রামে, মা, খুঁজতেই চোরকে ধরে ফেললাম। চোর ধরে মন্ত্রীর কাছে নিয়ে এলাম। মন্ত্রী বললেন, এই ব্যাটা চোর তুই ভুট্টা চুরি করেছিস? চোর বলল না, স্যার ভুট্টার মুচা দুটো। স্যার দুদিন থেকে খেতে পাইনি। খুব খিদা লেগে ছিল- জমিওয়ালা ধরে খুব মেরেছে- আমাকে ছেড়ে দিন আর চুরি করব না। মা, তখন মন্ত্রী বললেন- হুঁ, ব্যাটা আমার রাজত্বে চুরি! দারোগা ওকে নিয়ে লকআপে রাখো। আর রাত্রে এমন ভাবে পেটাবে যেন ও চুরি করা ভুলে যায়। মা, ওকে রাত্রে পেটাতে শুরু করলাম। ও শুধু বাবাগো মাগো বলে কাঁদে আর বলে না খেয়ে মরে গেলেও আর ভুট্টার জমিতে যাব না। তবুও ছাড়ি না- শেষ পর্যন্ত চোর অজ্ঞান হয়ে গেল। তখন তাকে হসপিটালে ভর্তি করলাম। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হল ডাক্তারকে বললাম ডাক্তারবাবু কাল ওর বিচার হবে, ওষুধ দিয়ে ওর জ্ঞান ফেরানোর ব্যবস্থা করুন। শিশু মাকে গড়গড় করে এক নিঃশ্বাসে খেলার বিবরণ শোনাল। আর মা একাগ্রে শুনল আর বলল, সোনামণি বড় হয়ে দারোগা হইও। কিন্তু বিনা বিচারে কারো গায়ে হাত দিও না। শিশু বলল-মা, মা কালকে মন্ত্রীর বিচার হবে কালকেও আমি দারোগা হব। আচ্ছা সোনামুণি চা-বিস্কুট খেয়ে নাও। চা বিস্কুট খাওয়ার পর শিশু বলল মা কালকে না, দেশের লোক থানা ঘেরাও করবে। এজন্য যে মন্ত্রী ৫০০০ কুইন্টাল রেশনের চাল কালোবাজারে বিক্রি করে ধরা পড়বে- জনসাধারণ রেশন না খেয়ে দুদিন ধরে ক্ষুধার্ত থাকায় আন্দোলনরত জনসাধারণ মন্ত্রীকে ঘেরাও করে ধরে গণআদালতে নিয়ে আসবে; গণ আদালতের রায় মন্ত্রীকে লকআপে রেখে ৪০ বেত মারতে হবে। আমি মন্ত্রীর হাতকড়া দিয়ে লকআপে নিয়ে গিয়ে ৪০ বেত মেরে সাজা দিব। না, না, না সোনামুণি তোকে দারোগা হতে হবে না। কাল তোকে খেলতে যেতে দেব না। কেন মা এই খেলা তো মিছিমিছি। বাছাধন শুনছো না সবাই বলছে ‘খেলা হবে’। রেশন চুরি গেছে যাক তুমি খেলতে যেওনা। মন্ত্রী বলছেন ‘খেলা হবে’, এমএলএ বলছেন ‘খেলা হবে’, এমপি বলছেন ‘খেলা হবে’, সাধু বলছেন ‘খেলা হবে’, চোরও বলছেন ‘খেলা হবে’। ‘খেলা’ এখন ফাঁপরে পড়েছে- মোটেই খেলার নাম নিবে না। পড়াশোনা করো সোনামুণি মানুষ হও।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই নেতার নেতৃত্বে মেনে চলা মনুষ্যজাতির স্বভাবজাত ধর্ম। কিছু লোক নেতা হবেন বাকিরা তাদের পশ্চাদে ঘুরবেন ইহাই তো দুনিয়াব্যাপী প্রচলিত বিধি। কখনো কখনো নেতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা সাধারণ মানুষকে অবোধ বালকের ন্যায় বশীভূত করে দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটাইয়া ফিরেছেন। মানুষের দ্বারা মানুষের রক্তে হাত রাঙিয়েছেন। রক্তের ফোয়ারা দেখে তৃপ্তি লাভ করেছেন।
গৃহহীনদের গৃহ বানিয়ে দিতে দেশ থেকে দেশান্তরে আলেকজান্ডার বা চেঙ্গিস বা তৈমুর কারো দ্বারে উপস্থিত হননি, এটা রাজা রাজড়াদের খেলা, রাষ্ট্রনায়কদের খেলা। এসব তো ইতিহাসের কথা- তবে শিক্ষা গ্রহণের জন্য তো ইতিহাস লেখা হয়।
ভারতবর্ষ ২৯টি রাজ্য নিয়ে ২৯ রকম ফুলের সাজানো ডালি। আমি তো আমাদের বাংলাকে সুদৃশ্য সুগন্ধময় গোলাপ জানি। তার গন্ধ শুকতে অনেকেই ছুটে আসছেন- আসাই স্বাভাবিক। ফলে গোলাপের পাঁপড়ি যেন কেউ ছেড়ে না নিয়ে যায় তার দেখভালের দায়িত্ব বাঙালির। হিন্দু-মুসলিম আমরা বাংলার মালি। বাংলার সৌন্দর্য রক্ষা করার দায়িত্ব বাঙালির। দক্ষিণের ঝড় হোক বা পশ্চিমে ঝঞ্ঝা, জাতপাতের ঝালাসে বাতাসে গোলাপের পাপড়ি জানো না শুকায় তার দেখভাল বাঙালিকেই করতে হবে। বাংলায় রাজনীতি হোক ভারতীয় বাঙালির মঙ্গলার্থে। বিশেষ জাতের বিশেষ ধর্মের নামে রাজনীতি যেন বাঙালি সত্তায় চিড় ধরতে না পারে।
আমরা বাঙালি শিক্ষিত হয়েছি, হাতে মাদুলি বেঁধে নিরাপত্তা ও মঙ্গল কামনায় বিশ্ব দরবারে পরিচিত হইনি। বরং বাঙালি মেধাবলে পৃথিবীতে তার গৌরব সমুজ্জ্বল করেছে। আজ আমরা রাজনীতির ঝড় ঝটিকাই পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছি। পরীক্ষায় আমাদের উত্তীর্ণ হতে হবে। ‘By the people, of the people, for the people’ এর বাস্তবায়ন আমাদেরকেই করতে হবে। আমরা আন্দোলন করে তুলতেই পারি-এক. স্বাস্থ্যমন্ত্রী হবেন একজন এমডি ডাক্তার। দুই. অর্থমন্ত্রী হবেন একজন অর্থনীতিবিদ। তিন. শিক্ষামন্ত্রী হবেন একজন পিএসডি স্কলার। চার. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন একজন আইএএস স্কলার। পাঁচ. ক্রীড়ামন্ত্রী হবেন একজন ক্রীড়াবিদ বা খেলোয়াড় ইত্যাদি। ফলে খেলা হোক দেশ গড়ার খেলা, খেলা হোক মানুষ গড়ার খেলা।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক বিশিষ্ট আলেম ও প্রাবন্ধিক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct