দিলীপ মজুমদার: যাঁরা মনীষী, যাঁরা প্রাতঃস্মরণীয়, তাঁদের ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে দেখলে অবাক লাগে। কিসের ভয়ে দৌড়াচ্ছেন তাঁরা? কোন ভূত তাড়া করেছে তাঁদের? এমন পড়ি-মরি করে দৌড়ান কেন? বিদ্যাসাগর দৌড়াচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ দৌড়াচ্ছেন। বিবেকানন্দ দৌড়াচ্ছেন। সুভাষচন্দ্র দৌড়াচ্ছেন। শুধু দৌড়াচ্ছেন না, তাঁরা চিৎকার করে অন্যান্য মনীষীদের সাবধান করে দিতে দিতে দৌড়াচ্ছেন। ‘এবার কার পালা, কে জানে, পালাও পালাও’।
সেদিন রাতে দাঁতের যন্ত্রণায় বড় কষ্ট পাচ্ছিলাম। আর সহ্য করতে না পেরে ডাক্তারের দেওয়া পেন-কিলার ট্যাবলেট গিলে ফেললাম। একটু ঝিমুনিমতো এলো, আর সেই ঝিমুনি ধরা অবস্থায় আমি দেখলাম এক অলৌকিক দৃশ্য। প্রাণভয়ে দৌড়ে পালাচ্ছেন আমাদের বরেণ্য মনীষীরা।
পালাতে পালতে অনেকদূর এসে তাঁরা দেখলেন আর কেউ তাঁদের অনুসরণ করছে না। তখন ক্লান্ত হয়ে তাঁরা নির্জন প্রান্তরে এক বটবৃক্ষের তলায় বসলেন। বিদ্যাসাগর বললেন, ‘রবি, তোমার কবিতা তাহলে বাজেট বক্তৃতায় স্থান পেলো!’ রবীন্দ্রনাথ বিরক্তির সঙ্গে বললেন, ‘এখন মনে হচ্ছে নিজের লেখা সব পুড়িয়ে দিয়ে আসি।’
বিবেকানন্দ ক্লিষ্ট হাসি হেসে বললেন, ‘সেটা আর সম্ভব নয় রবীন্দ্র। আমরা দেহধারী হলে, মর্ত্যভুমিতে থাকলে, হয়তো সম্ভব হত। তাও বোধহয় হতো না। কারণ সেসব লেখা মাইক্রোফিল্মে, পেনড্রাইভে, ফেসবুকে, টুইটারে উঠে গেছে। কত মুছবেন, কত পাল্টাবেন !’
সুভাষচন্দ্র মৃত্যুর পরেও তরতাজা যুবক। আগের মতো তেজোদীপ্ত গলায় তিনি বললেন, ‘কিন্তু তাই বলে আমাদের দিয়ে সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা হবে কেন? যেসব মানুষের শুভবুদ্ধি আছে তারা তো প্রতিবাদ করতে পারে।’
বিদ্যাসাগর বললেন, ‘প্রতিবাদ তো হচ্ছে। আমার মৃর্তিভাঙা নিয়ে, রবির শান্তিনিকেতনে পাঁচিল দেওয়া ও ভাঙা নিয়ে, বিবেক ও সুভাষের গলায় বিশুদ্ধ হিন্দুত্বের তকমা পরানো নিয়ে প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু ভালো করে খোঁজ করে দেখো, দেখবে প্রতিবাদের ভেতরেও রাজনীতি আছে। বাঙালি জাতির অস্থিমজ্জায় মিশে গেছে রাজনীতি। হয় এ দলের রাজনীতি, না হয় সে দলের রাজনীতি। রাজনৈতিক দলগুলো নিজের নিজের স্বার্থে হয় আমাদের প্রশংসা করে না হয় তুমুল নিন্দা করে, সত্যিকারের সমালোচনা করে না।’
হঠাৎ তাঁরা দেখলেন তিনজন কবি হাত ধরাধরি করে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছেন। মধুসূদন, নজরুল আর জীবনানন্দ। তাঁদের মুখে ভীতির ছাপ নেই দেখে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্ররা অবাক হলেন। নজরুল বললেন, ‘গুরুদেব, আপনাদের দৌড়াতে দেখে বড় কষ্ট হয়েছে।’
রবীন্দ্রনাথ অবাক হয়ে বললেন,’ সে কী. তোমাদের ভয় করছে না ?’
মধুসূদন বলেন, ‘না, আমাদের আপাতত সে ভয় নেই।’
-‘কেন? কেন?’ –প্রশ্ন করেন সুভাষচন্দ্র।
মধু বলেন, ‘আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে দুটো জিনিস। প্রথমত আমি খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করেছিলাম, আর দ্বিতীয়ত আমি লিখেছি মেঘনাদবধকাব্য। সেই কাব্যে রামকে আমি ভীরু, কাপুরুষ, পররাজ্যলোভী, ভিখারি বলেছি। তাই ওরা আমাকে অস্পৃশ্য ভাবে। আমাকে দাবার ঘুঁটি করবে না। আমার জন্মদিন পালনেরও হুড়োহুড়ি হবে না।
নজরুল বললেন, ‘আমি মুসলমান বলে অস্পৃশ্য। আমাকেও দাবার ঘুঁটি করবে না। আমার জন্মদিন পালনেরও প্রতিযোগিতা হবে না।’
এবার জীবনানন্দ হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমারও ভয় নেই খুব একটা। কারণ আমাকে চেনে না ভালো করে। তাই ভারতচন্দ্র রায়ের লেখা কবিতার লাইন আমার লেখা বলে চালিয়ে দিয়েছিল।’
ততক্ষণে পেনকিলারের প্রভাব কেটে গেছে। আবার উৎকট যন্ত্রণা শুরু হয়েছে দাঁতের। তাই ঝিমুনিটাও কেটে গেছে। আমি শুধু ভাবলাম, মহাপুরুষরা বড় দুঃখি মানুষ।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct