দিলীপ মজুমদার: আজ থেকে বছর চারেক আগের কথা। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর। রাত ৮টা। ভেসে এল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠস্বর। তিনি ঘোষণা করলেন ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট বাতিল করা হল। তিনি কালোটাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছেন। কী কঠিন তাঁর সিদ্ধান্ত। কী অনমননীয় পদক্ষেপ। পরের দিন থেকে ব্যাঙ্কে বিরাট বিরাট লাইন। প্রাণান্তকর অবস্থা। কিন্তু মানুষ তখন গ্যাসাচ্ছাদিত। আমাদের পাড়ার সরল-সিধে হাবুদা বললেন, ‘ এবার জব্দ হবে কালোটাকার কারবারীরা।’
তারপর ?
আমার কথা ফুরাল, নটে গাছটি মুড়াল। দিন গেল মাস গেল। আমরা সবাই ব্যাঙ্কে লাইনে দাঁড়ালাম। জমা দিলাম ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট। তারপরে জানা গেল কালোটাকা ভালো মানুষের মতো গা ঢাকা দিয়েছে। বরং উল্টোদিকে অর্থনীতিতে কুফল ফলেছে। জিডিপি বৃদ্ধির হার কমার সঙ্গে সঙ্গে ছোট আর মাঝারি ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়েছে। জাল নোট বেড়েছে ২০%।
তাহলে কী বলতে চান. আমাদের সরকার আর তার মাথা অর্থনীতিটা বোঝেন না ? অর্থনীতি বোঝার দায় কী কেবল অমর্ত্য সেনদের ? বাজে কথা মশাই। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যে অর্থনীতিতে বিশেষ পারদর্শী তার প্রমাণ ‘মোদিনোমিক্স’। ইকনোমিক্স হল অর্থশাস্ত্র। আর প্রধানমন্ত্রীর ইকনোমিক্স হল মোদিনোমিক্স। নোটবন্দির আট মাস পরে নতুন অর্থনীতির স্রষ্টা আবার একটা ইতিহাস রচনা করলেন। লাগু করলেন জিএসটি বা গুডস সার্ভিস ট্যাক্স। এক্সাইজ, ভ্যাট, সার্ভিস ট্যাক্সের পরিবর্তে।
উদ্দেশ্য মহৎ। এক দেশ এক ভাষা এক দলের মতো এক দাম, এক কর। তবে নিন্দুকেরা বলল এটা ‘গব্বর সিং ট্যাক্স’। তারা বলল দেশকে প্রস্তুত না করে জিএসটি লাগু করায় ল্যাজে-গোবরে ব্যবসায়ীরা। রাজ্যের সঙ্গে বিরোধের ক্ষেত্রও তৈরি। নিন্দুকদের পাত্তা দেবেন না। তারা তিলকে তাল করে। তাঁকে অনুভব করুন। তাঁর নাম জপ করুন।
দেশের অর্থনীতিকে তরতাজা যুবক করে তুলবেন তিনি। বছরে ২ কোটির কর্মসংস্থান হবে। আসবে ‘অচ্ছে দিন।’ কিন্তু দেখা গেল গত ৪৫ বছরে সবচেয়ে বেশি বেকারত্বের হার—৬.১%। তাতে কী, তাতে কী ! আমাদের লোকেদের আসতে দিন, তাঁরা বুঝিয়ে দেবেন কত ধানে কত চাল। আপনারা দেখতে জানেন না, তাই দেশের শ্রীবৃদ্ধিটা দেখতে পাচ্ছেন না। হয়তো দেখেও দেখতে চাইছেন না। আপনারা – আপনারা দেশদ্রোহী।
তাই আমরাও রাষ্ট্রীয় নজরদারি শুরু করেছি। অনেকটা চিনের মতো। যদিও চিন আমাদের শত্রু। তাই বলে শত্রুর কাছে কী শেখার কিছু নেই ? আধার কার্ডের নম্বর টিপলে আপনার ব্যক্তিগত তথ্যের পর্দা ফাঁই। কত টাকা জমাচ্ছেন, কী করছেন, কোথায় যাচ্ছেন, এসব জানা দরকার। নাগরিকত্ব সংশোধনের পেছনেও এরকম গূঢ় ব্যাপার আছে মশাই।
আসলে জাতীয়তাবাদের জিগিরটা মানুষ খায় ভালো। যেমন সার্জিকাল স্ট্রাইক। সেই স্ট্রাইকের পরের দিন পাড়ার রিকশাচালক বিজয় বলল, ‘দেখেছেন বুকের পাটা। পাকিস্তানে ঢুকে ঝেড়ে দিয়েছে।’ এখানেও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টির কথা আসে। ২০১৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারির রাতের সার্জিকাল স্ট্রাইক। সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। এর মধ্যে যুদ্ধ বিমান পাঠানো নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন বিশেষজ্ঞরা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেই সব তুচ্ছ দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে হাজির হলেন তাঁর নতুন ‘মেঘনাদতত্ত্ব’ নিয়ে। বললেন, ‘ আকাশে মেঘ আছে বলে আমরা ক্লাউড বেনিফিট পেতে পারি। পাকিস্তানের রাডার আমাদের যুদ্ধ বিমানের হদিশ পাবে না।’
তিনি এখন রবীন্দ্রভক্ত। রবীন্দ্রনাথের পথেই তিনি গড়ে তুলতে চান আত্মনির্ভরশীল ভারত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে বলেছেন ‘এসো হে আর্য এসো অনার্য হিন্দু মুসলমান’। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের প্রচণ্ড নিন্দা ও বিরোধিতা করেছেন। তাকে কী ! মহাপুরুষরা এরকম এক-আধটু স্ববিরোধী কথা বলেন। আমরা তাঁদের আমাদের মতো করে নেব।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct