দিলীপ মজুমদার: নতুন বছরের গোড়াতে শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরি হাটে যে অভিজ্ঞতা হল, তা কোনদিন ভুলতে পারব না। করোনার জেরে হাট তেমন জমেনি। পেটের দায়ে কিছু মানুষ গাছের তলায় তাঁদের জিনিসপত্র সাজিয়ে বসেছে। ঘুরতে ঘুরতে একটু দূরে দেখি এক গাছের তলায় এক মাঝবয়সী মানুষ হাত-পা নেড়ে কী বলে যাচ্ছে। পাঁচ-সাতটি মানুষ তার সামনে দাঁড়িয়ে। কাছে গিয়ে মনে হল লোকটি পাগল। কিন্তু সে যা বলে যাচ্ছে, তা পাগলের আজে-বাজে কথা নয়। তবে তার ভাষায় সাধু-চলিত মেশানো। এটা বোধহয় পাগলামির লক্ষণ।
লোকটি বলছে, ‘বন্ধুগণ কুস্তি জমিয়া উঠিয়াছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়ে নাই। আপনারা সব দেখেছেন। ঘাসফুল কুস্তি করিল, পদ্মফুল কুস্তি করিল, হাত আর কাস্তে-হাতুড়ি হাত ধরাধরি করিয়া দূরে দাঁড়াইয়া সেই কুস্তিকে মদত দিতে দিতে ঘাসফুল আর পদ্মফুলকে গালাগালি দিতে লাগল।’
বুঝলাম পাগল শান্তিনিকেতনে ঘাসফুল আর পদ্মফুলের রাজনৈতিক সমাবেশের কথা বলছে। কিন্তু সে বির্তককে কী কুস্তি বলা যায় ? একটু ভাবতেই মনে হল, হ্যাঁ, কুস্তিতো নিশ্চয়ই। ক্ষমতা দখল করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলি এক ধরনের কুস্তিতে নেমে পড়ে। কথার কুস্তি, কুৎসার কুস্তি, খিস্তির কুস্তি। নির্বাচন এলে কুস্তির রগড় বেড়ে যায়। পালোয়ান বলে মনে হয় নেতাদের। বিরোধী দলের ছায়ার সঙ্গে কুস্তি করে যান তাঁরা। সকাল থেকে সন্ধে। ছায়ার সঙ্গে কুস্তি করে গাত্রে ব্যথাও হয়।
ভোটের ঢাকে কাঠি পড়েছে রাজ্যে। তাই জেলায় জেলায়, মহকুমায় মহকুমায়, মহল্লায় মহল্লায় জমে উঠেছে কুস্তির আসর। এ ওকে বলছে ‘চোর’, সে তাকে বলছে ‘ডাকাত’। এরা প্রত্যেকেই গণতন্ত্রের মহান পূজারী বলে বুক চাপড়াচ্ছে নিজেদের। আবার একে অন্যকে বলে যাচ্ছে ‘গণতন্ত্রের হত্যাকারী’। এসব দেখেশুনে মাঝে মাঝে মনে হয় গণতন্ত্র বোধহয় বহুবল্লভা। একজনের ঘর করা ধাতে নেই তার।
হাটে হাঁড়ি ভাঙার কেউ নেই। কেননা ‘নিরপেক্ষ’ বলে কেউ নেই। এ দল না হয় সে দলে। জনতা জনার্দন তো ঘাবড়ে ঘোড়া হয়ে যায়। প্রত্যেক দলের কাছে আছে চোখা চোখা যুক্তি। আছে অসংখ্য তথ্য। তথ্যের পাহাড়। তথ্যের মহামারি। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যে? বুঝতে বুঝতে ইন্তেকাল আসন্ন।
আমাদের রাজনৈতিক কুস্তিগিরেরা ইউনিক সেলিং প্রোপোজিশন (ইউএসপি) তৈরি করার জন্য এবার আমাদের মহাপুরুষদের আঁকড়ে ধরতে চাইছেন। বড় জবরদস্তভাবে। কণ্ঠ আঁকড়ি ধরিল পাঁকড়ি। তাই টানাটানি চলে মহাপুরুষদের। বিদ্যাসাগর তুমি আমার, রবীন্দ্রনাথ তুমি শুধু আমার, নেতাজি সুভাষ আমার ছাড়া অন্য কারও নয়। এঁরা তো আমাদের কথাই বলে গিয়েছেন। নস্ত্রাদামুসের মতো অনেককাল আগে যা বলে গিয়েছেন, তাই তো আমরা করে যাচ্ছি। মহাপুরুষরা ভাগ্যিস মারা গেছেন। মরে বেঁচেছেন তাঁরা। তা নাহলে দলীয় টানাটানিতে অকালে আত্মহত্যা করতে হত তাঁদের।
সোনাঝুরির পাগলের সঙ্গে একটা বিষয়ে একমত হতে পারলাম না। সে পাগল রাজনৈতিক লোকেদের শুধু কুস্তিগির বলেছিল। না, তাঁরা শুধু কুস্তিগির নন। তাঁরা জাদুকরও। প্রকাশ্য দিবালোকে তাঁরা আলোকে কালো, সত্যকে মিথ্যা, ছাগলকে কুকুর বানিয়ে দিতে পারেন। হাসি-কান্না-হিরা-পান্না দিয়ে জনতার মন জয় করেন তাঁরা। প্রতিশ্রুতির মৃত্যুঞ্জয়ী রস পান করিয়ে তাঁরা চাঙ্গা করে দেন নিরাসক্ত মানুষকে। আশ্চর্য জাদুতে নেতা হয়ে যান অভিনেতা। দিলীপকুমার-অমিতাভ বচ্চন-উত্তমকুমাররা এঁদের কাছে শিশু।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct